Sunday, September 27, 2009

জোসেফ সাংমার না লেখা গল্প

বেশ কিছুদিন যাবৎ ভোরবেলা আতংকিত হয়ে ঘুম ভাঙে জোসেফের। এমনটি হবার কারণ সে খুঁজে বের করেছে আজ... কিছুদিন পূর্বে সে গ্রেগর সামসার পোকা হয়ে যাওয়ার কাহিনীটি পড়েছে এবং জেনেছে যে, হঠাৎ একদিন গ্রেগর সামসা ঘুম থেকে জেগে দেখেন তিনি পোকায় পরিণত হয়েছেন। জোসেফেরও মনে হচ্ছিল যে, হঠাৎ তিনিও কোনদিন ঘুম থেকে জেগে দেখবেন তার দুটো মাথা হয়ে গেছে কিংবা হাতদুটো পশ্চাতের দিকে একেবারে নিতম্বের কাছাকাছি ঝুলছে অথবা চোখ দুটো বুকের দুই স্তনবৃন্তে মিটমিট করছে আবার এও হয়ে যেতে পারে যে, তার লিঙ্গটি এবং সমস্ত বস্তি এলাকা চলে এসেছে ঠিক কপালের মাঝখানে (নিতান্তই প্রকৃতি বিরুদ্ধ কল্পনা)। অবশ্য বিষয়টি তার পুরোপুরি বিশ্বাস হয় না কেননা এমন ঘটনা মনুষ্য প্রজাতিতে কখনো দেখা গেছে বলে শুনেনি। বিজ্ঞান যদি কোনোভাবে বিষয়টি সত্য বলে কখনো প্রমাণ করতে পারে তবে তার বিশ্বাস হবে।
জোসেফ সাংমা একজন লেখক, মূলত সে উপজাতিয়। আমাদের উত্তরাঞ্চলে উপজাতিয়দের মধ্যে একজন লেকক আছেন এটি বিষ্ময়কর একটি বিষয়! কেননা এ অঞ্চলে উপজাতিয়দের মধ্যে ইতিপূর্বে কোনো লেখক ছিলেন বলে শুনিনি। এ অঞ্চলে উপজাতিয়দের মধ্যে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন কোনো লেখক না থাকার সম্ভাবনাই বেশি ছিল, কেননা এখানকার উপজাতিয়রা ছিল চাষাভুষা, খেটে খাওয়া মানুষ; অধিকাংশই অক্ষরজ্ঞানহীন। অবশ্য খ্রিষ্টান মিশনারীদের মাধ্যমে এরা ধর্মকর্ম ও শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে আসছিলো বহুদিন যাবৎ। খুব সম্ভবত দেশ স্বাধিন হবার পর এদের-কে রাস্ট্রিয় কাঠামোতে বাঙলাভাষায় শিক্ষাদীক্ষা দেবার সুযোগ দেয়া হয়। তারই প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের উপজাতিয়রা এখন বেশ আলোকিত। এই সময় উপজাতিরা আধুনিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করছেন। জোসেফের পরিবারটিও তাই, চাষাভুষা দলের কিন্তু মিশনারী শিক্ষার প্রভাবে সে এবং তার ভাই-বোনদের অক্ষরজ্ঞানহীন থাকতে হয়নি।
জোসেফ সাংমার লেখক হয়ে ওঠাটা খুব বেশি গুরুত্বের বিষয় নয়। স্থানিয় যেসব ম্যাগাজিন, স্মরণিকা ছিল ওসবেই ছিল তার লেখার পরিধি। সে আসলে উপজাতিয়দের বিষয়ে তার বিভিন্ন ভাবনা প্রকাশ করে যাচ্ছিলো কিন্তু বিষয়টি উপজাতিয়দের মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্যই হয়ে ওঠেনি। একবার তার বন্ধুদের উৎসাহে স্থানিয় একটি উৎসবে গান লিখে দিতে হয়। সেদিন থেকেই মূলত তার লেখক পরিচিতিটা বাড়তে থাকে। তার বেশ মনে পড়ে গানটি শোনার পর খ্রিষ্টান মিশনের ম্যানেজার রথীন নকরেক তার পিঠ চাপড়িয়ে ধরেছিলেন। তারপর এই ম্যানেজারের চেষ্টায় মিশনারী কালচারাল একাডেমি থেকে তার লেখা গান নিয়ে একটি ক্যাসেট বেরোয়। ‘হাই খাম্বাইসাং রেনেকা’ চলো উত্তের যাই। এভাবেই ধীরে ধীরে সাহিত্যে তার পূর্ণ প্রবেশ।
বেশ কদিন যাবৎ গ্রেগর সামসার বিষয়টি মাথার মধ্যে ক্রিয়েট করার ফলে সে হতাশ হচ্ছিলো এই ভেবে যে, বোধ হয় ইদানিং পাগলামি বেশি করছে সে কিন্তু আজ নিজেকে কেন জানি তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে এবং বেশ ভালো মনে চা-নাস্তা সেরে লেখার টেবিলের দিকে যায়। আজ সে একটি গল্প লিখবে প্রথম। যে বিষয়টি গল্পাকারে লিখতে গিয়ে সে আজকের লেখক অথচ সেই গল্পটি আজো তার লেখা হয়ে উঠলো না।
টেবিলের উপর কাগজ সবই ঠিকঠাক কেবল উডপেন্সিলটা কাটা হয়নি। এই এক উৎপাত, এইসব টুকিটাকি কাজ সাধারণত কনসান্টেশান ব্রেক করে। জোসেফের মন খারাপ হয় আবার সে পিন্সলটা ছাড়া লিখতে স্বাচ্ছন্দও বোধ করে না। এই পেন্সিল ছাড়া লিখতে না পারাটাও আশ্চর্য লাগে! একসময় মানুষ নলখাগড়ায় কালি ভরে বিভিন্ন গাছের পাতায় লিখতো। আজকের মানুষের কাছে বিষয়টি আশ্চর্যের- কেননা তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন অত্যাধুনিক কলম ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছে।
ভবিষ্যতের মানুষের কাছে এই বলপেন ব্যবহার তথা হাতে লেখাটাও আশ্চর্যের মনে হতে পারে কেননা তখনকার মানুষেরা লেখার সমস্ত কাজ করবে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, রাউডারে। এ ব্যাপারে সে একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প পড়েছিল মনে পড়ছে তার ‘গল্পকার অমিত কহ্লার যেভাবে মিথ কহ্লার হয়ে যান’ গল্পটি মুজিব মেহদী’র লেখা ‘নিসর্গ’ নামে একটি ছোটকাগজে ছাপা হয়েছিল। পরে তার গল্প বইয়েও মুদ্রিত হয়েছে। বিষয়টি তারও পুরোপুরি বিশ্বাস হয় কিন্তু কিন্তু সে নিজে উডপেন্সিল ছাড়া লিখবে না এটাই তার স্বাভাবিক ইচ্ছা। ইরেজারে পেন্সিলটা কাটতে কাটতে হঠাৎ মনে পড়লো তার সেই পুরনো গল্পটি বোধ হয় লেখার প্রয়োজনিয়তা আর নেই। কেননা উপজাতিয়রা আজ শিক্ষাদীক্ষায় সর্বাগ্রে অবস্থান করছেন ফলে একদিন এরা নিজেদের প্রয়োজনেই ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্প সাহিত্য খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনবেন।
এ অঞ্চলে উপজাতিয়দের মধ্যে যরেথষ্ট ধর্মসাম্প্রদায়িকতা থাকা সত্ত্বেও প্রকটভাবে পালিত হতো না এই জন্যে যে, এ অঞ্চলে হিন্দু বা মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনের তুলনায় উপজাতি ছিলো হাতে গোনা কিছু পরিবারমাত্র ফলে মুসলিম ও হিন্দুদের অত্যাচারে ওদের নিরবে সহ্য করতে হতো। সম্পত্তিগ্রাসের চেয়েও যে অত্যাচারটি বেশি প্রকটভাবে দেখা গিয়েছিল সেটি হচ্ছে নারী নির্যাতন। এইসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কারুরই প্রতিবাদ করা সম্ভব ছিল না তখন কেননা তাতে অস্তিত্ত বিলোপের সম্ভাবনাই বেশি ছিলো। তাছাড়া সীমান্তএলাকা রক্ষার নামে যারা প্রশাশনিক ক্ষমতা নিয়ে যেতেন তারাও একইভাবে ভোগিদের দলে অন্তভুক্ত হতেন। উপজাতিয়দের এই স্বাধিনতা হরণের বিষয়টির বিপক্ষে অত্যন্ত প্রকট আকারে একটি গোত্র সংগঠিত হতে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে যার আগুন শেষপর্যন্ত গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তো।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় শেষমেষ বিষয়টি ডিশমিশ হয়ে যায়। সেদিনের সেই উত্তেজনা, সেই প্রতিবাদি সত্তাটিই আজকের লেখক জোসেফ সাংমা। কিন্তু দীর্ঘদিনেও জোসেফের গল্পটি লেখা হয়ে ওঠেনি কেননা সেদিনের সেই উপজাতিকুল আজকের যে সমাজে অবস্থান করছেন তাতে কারো কারো পারিবারিক ব্যক্তিত্বে আঘাত পড়াই স্বাভাবিক কেননা যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য পাহাড়ের কাটালতা ভেঙে আলোর প্রবেশক-কে দেখেছিল হয়ত তারই ফাঁকে ফাঁকে পঙ্কিলতাও প্রবেশ করেছিল।