Monday, January 30, 2023

সেরিগ্রাফ

তপদায়ী বিবির বিস্কুট না খেলে মানুষের অমঙ্গল হয়। এটাই নিয়ম, এখানকার মানুষজন বলে থাকে। বিবি সাহেবার মাজারটি দেখতে ভীষণ সুন্দর। দূর থেকে দেখলে বোঝা যায়। দুটি বৃহৎ পাহাড়ের বেস্টনিতে এক রাজবাড়ি যেন। সমুখেই অসীম সমুদ্রের উথাল পাথাল বিশাল ঢেউয়ের গর্জন। প্রকৃতির এই অপার জলরাশিই বিবি সাহেবার মাজারকে বিশেষ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। তাই মাজারে আসা সকলেই যে শুধু মানতের জন্যই আসেন এমন নয় কেউ কেউ আসেন অপার জলের এই লীলার মাঝে নিজের ক্ষুদ্র বিষণœ গণ্ডোলাটি পরখ করে নিতে, আদতেই সেটি বিশ্বলীলায় সচল কোনো বান্ধব হয়ে ওঠে কিনা। কখনোই সম্ভব নয়। সমুদ্র বিশাল। মানুষের চিন্তার চেয়েও অনেক বড়। বিশাল জলরাশির দিকে তাকিয়ে এমনই একটি চিন্তার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল সবুজ। তার মনযোগ ভাঙে বিশাল জলরাশির দিকে ছুঁড়ে দেয়া প্যাকেটভর্তি মিষ্টির ঘটনায়। মিষ্টির প্যাকেটটি জলের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে একটি মেয়ে। তিনদিন হয় সবুজ মাজারে এসেছে। সমুদ্রের হাওয়ায় ওর চেহারায় কালোমতো এক ধরনের ছাপ পড়েছে। সবুজ দেখছে মেয়েটির চেহারায় তেমনি এক বিষণœতা গ্রাস করে রেখেছে। কিছু জিজ্ঞেশ করবে ভেবে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায় সবুজ। সে সমুদ্রের জলরাশির দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে গলায় হালকা কাশির আওয়াজে জিজ্ঞেশ করে সবুজ, কিছু মনে করবেন না একটা প্রশ্ন করতে পারি? অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকায় মেয়েটি, জ্বী, আপনি? প্রশ্ন করে আল্পনা।

—আমি জিহাদ করিম সবুজ। গত তিনদিন হলো মাজারে এসেছি। আজকেই আপনাকে মাজারে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। আপনার সাথে পরিচিত হতে পারলে ভালো লাগতো।
—আমি আল্পনা শিকদার। ছবি আঁকি। আপনি কিছু জিজ্ঞেশ করতে চেয়েছিলেন।
—একটু আগেই দেখলাম আপনার হাতে একটি মিষ্টির প্যাকেট ছিল। সমুদ্রের জলে তা ফেলে দিয়েছেন। এটা কেন করলেন, কোনো কারণে মন খারাপ হয়েছে নিশ্চয়?
—আসলে মিষ্টিগুলো মাজারের কবরষাঁড়ের জন্য মানত করে নিয়ে এসেছিলাম। খায়নি তো তাই সমুদ্রেই ফেলে দিলাম।
সবুজ বুঝতে পেরেছে কবরঘড়ের ষাঁড় মিষ্টিগুলো খায়নি বলে আল্পনার মন একটু খারাপ হয়েছে। সেও ষাঁড়ের জন্য এককাদি কলা নিয়ে এসেছিল। খেয়েছে। মাজারের ষাঁড় কিছু খেলে মানুষের মানত পূর্ণ হয়। কারো প্রত্যক্ষ আবার কারো অবচেতনেই পূর্ণ হয়। কিন্তু ক্ষতি হয় কিনা সবুজের জানা নেই। সে আল্পনাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে। মানুষের জীবনটা একটা ঝাপসা আয়না। কখনো নিজেকে স্পষ্ট দেখা যায় আবার কখনো দেখা যায় না। তবু মানুষ বিশেষ অন্বেষায় বারবার নিজেকে স্বচ্ছ আয়নার মতো দেখতে চায়। মন খারাপ করবেন না। এবার ষাঁড় মানত খায়নি কিন্তু আগামীবার তো খেতে পারে। আল্পনারও এরকমই বিশ্বাস। সে বহুবার মাজারে এসেছে, মানত এনেছে কিন্তু এবারই প্রথম কবরষাঁড় তার মানত খায়নি। বিশেষ প্রত্যাশা করে সে এবার নেত্রকোণার বিখ্যাত মিষ্টি কিছু বালিশ আনিয়েছিল কবরষাঁড়ের জন্য।
তপদায়ী বিবির মাজারের তবারক না খেলে মানুষের অমঙ্গল হয়। আর খেলে মন ভালো হয়ে যায়। সেই তবারক বিস্কুট বিতরণ শুরু হয়েছে। সবুজ, আল্পনা বসে আছে সমুদ্রের দিকে চেয়ে। খেদমতকারীরা বিস্কুট দিয়ে গেছে। তবারক খেতে খেতে আল্পনা সবুজের কাছে জানতে চায়, অনেকক্ষণ আমরা কথা বলে চলেছি কিন্তু আপনার সম্পর্কে ভালো করে জানা হলো না।
—আপনার হোম ডিস্ট্রিক্ট কোথায়? কী করছেন?
—রাজশাহী। কিছু করার কথা আসলে আপনাকে বলতে পারবো না। দর্শনে মাস্টার্স শেষ করেছি ৫/৬ বছর হয়ে গেলো। চাকরি হয় না। ২৭টা সিভি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোথাও ভালো কোনো রেসপন্স নাই। বলতে পারেন বেকার। মাঝেমধ্যে গানের কথা লেখার চেষ্টা করি।
—আপনি তাহলে গীতিকার। বাহ্ খুবই চমৎকার মনের মানুষ আপনি। আপনার সাথে আরো কথা বলতে পারলে আমারও ভালো লাগতো।
—গীতিকার হলেই যে চমৎকার মনের মানুষ হয় এমন নয়। তবে নিজেকে একজন চমৎকার মনের মানুষ হিসেবে ফিল করি মাঝেমধ্যে। তাতে কী হয়? আমাদের জ্ঞানের পরিধি এত দুর্বল যে সঠিক বিবেচনায় আমরা যা ভালো চিন্তা করি মনে করে ধরি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হিতে বিপরীত ধারণার। নিজের দুর্বলতাকে আমরা বর্জন করে চলতে পারি না। তবু তো কখনো সখনো আমাদের মাঝে চমৎকার মনের মানুষ মিলে। কথা আরো বলা যায়। চলেন তার আগে আমরা এককাপ চা খেয়ে আবারো এখানে এসে বসি।
—দারুণ মজার কথা বলেছে আপনি, ঠিকাছে চলেন। চা খাওয়ার পর আপনার লেখা গানের কথাগুলো শুনবো। সম্ভব হলে একটু গেয়েও শোনাবেন।
একটাই আকাশ অসীম আকাশ আকাশটাকে দেখি
আকাশভরা লক্ষ তারার মেলা
একটি তারা আমার কথা, একটি তারা কবিতা যেন
একটি তারা গান
কাচের গুঁড়ো তোমার চুড়ি
বেলকনিতে হৃদয়ের গল্প শূন্যতা খানখান।
—বাহ্ খুবই চমৎকার। অসম্ভব সুন্দর একটি গান লিখেছেন আপনি। কথাগুলো শুনতে শুনতে ছবির মতো একটি কবিতার ঘোরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের শিল্পবোধ আসলে খুবই সাধারণ কিন্তু সকল মানুষ তা সহজে বুঝতে চায় না। প্রথমে আমিও বুঝতাম না। খুব সাধারণ একটি বিষয় মনে পড়ছে আপনাকে বলি। চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর প্রথম দিনেই আমরা ক্লাশে পেয়েছিলাম ঢালি আল মামুন স্যারকে। অসামান্য একজন শিল্পী অসামান্য তাঁর শৈল্পিক নান্দনিকতা। প্রথমেই আমার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন তাঁর নান্দনিক প্রজ্ঞায়। ক্লাশে সকলেরই একটি করে ছবি আঁকার কথা ছিল। কেউ কেউ সফল হলেও সেদিন আমি কোন ছবি আঁকতে পারছিলাম না। শুধু একটি ফিগার আঁকার চেষ্টা করেছিলাম তাও হয়নি। মামুন স্যার খুব সহজেই এঁকে দেখালেন। একটি সরল ছবিও কীরকম অসাধারণ নান্দনিকবোধে ফুটে উঠতে পারে। পানির উপর ভাসছে একটি শুকনো মলিন পাতা তার নিচে মেলে ধরা হাতের পাঁচটি আঙুল। সূর্যকিরণ পড়ছে পানিতে। খুবই সুন্দর চিত্রকল্প, তাই না? গানের ব্যপারটাও আমার কাছে তেমনই সঞ্চারণশীল বিষয় বলে মনে হয় কিন্তু সাধারণ মানুষের ধারণা এবং আবেগটা আমার কাছে পরিষ্কার হয় না। আল্পনা আবার অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকায় সবুজের দিকে। আচ্ছা আপনি মাজারে কেন এসেছেন সেটা তো জানা হলো না।
—আসলে মাজারে আসিনি আমি। সবুজ বলে। স্যোসাল ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এসডিএফ) একটি প্রজেক্টে নিয়োগের জন্য এখানে ডেকেছে আমাকে। আগামীকাল ভাইবা অনুষ্ঠিত হবে। সেজন্য এসেছি। আল্পনা আবার অদ্ভুত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকায়। সবুজ দেখে বিষণ্ন মলিনতায়ও আল্পনার চোখে এক ধরনের সহাস্যবদন দৃষ্টি। এখানে আসার পূর্বে আমার পরিচিত একজন বিবি সাহেবার মাজারের কথা বলেছে। বলেছে সহিদিলে মাজারে কোন মানত করলে তা পূর্ণ হয়। সেজন্যও এসেছি। এসে দেখলাম মাজারটি দেখতেও ভীষণ সুন্দর। আর আপনার সাথে দেখা হওয়াতে আরো বেশি ভালো লাগছে।
আল্পনা বলে মাজারে এসে আমার একটা বিশেষ লাভ হয়েছে, জানেন?
—কী লাভ হয়েছে বলেন তো শুনি।
আল্পনা তার শিটহোল্ডারের ভিতর থেকে ভাঁজকরা আর্টপেপার খুলে একটি ষাঁড়ের ছবি দেখায়। খুবই সুন্দর ক্ষীপ্র একটি ষাঁড়ের তেজি ভঙ্গির ছবি। মাজারে আসার পর কবরষাঁড়টি দেখে আমি এই ছবিটি আঁকার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। মাজারের কবরঘরে মানুষের বন্দি সেই ষাঁড়টিরই একটি বিপরীত গতিময়তাই আমি এই ছবিটিতে ধরতে চেয়েছি।
সবুজ কিছুক্ষণ ছবিটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে পর্যবেক্ষণ করে। লাল-সবুজ রঙের অপূর্ব মিশ্রণের মাঝে গাঢ় কালোরঙে ষাঁড়টি খুব সুন্দর দেখায়। তারপর বলে...
—খুবই সুন্দর ছবি। ছবিটি কী আপনার কোনো প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে?
Ñনা। ছবিটি আমার সাম্প্রতিক আঁকা। এশিয়ান ত্রিদেশিয় একটি চারুকলা প্রদর্শনীতে আমার অন্য তিনটি ছবি স্থান পেয়েছিল।
—আপনার পরবর্তি প্রদর্শনীতে এই ছবিটি রাখবেন। আমার অনুরোধ। খুবই সুন্দর ছবি।
—আল্পনা বলে, আমার পছন্দের একটি বিশেষ ছবি এটি। আপনি না বললেও চবিটি আমার পরবর্তি প্রদর্শনীতে আমি রাখতাম। ছবিটি আপনার কাছে সুন্দর লেগেছে বলে আপনাকে স্পেশাল থ্যাঙ্কস্। প্রদর্শনী হলে আপনার কথা আমার মনে পড়বে। প্রদর্শনীর সময় আপনি নিজে উপস্থিত থাকলে, আপনি যদি আমার প্রদর্শনী দেখতে আসেন তাহলে আরো বেশি খুশি হবো।
—সবুজ জানায়, যদি বেঁচে থাকি আপনি জানালে আমি অবশ্যই প্রদর্শনী দেখতে আসবো। থাকতে পারলে আমারও ভালো লাগবে।
আল্পনার চেহারার মলিনতা প্রায় কেটে গেছে। খানিক পূর্বেই যে কালো ছায়া তাকে গ্রাস করে রেখেছিল তা এখন আর নেই। বিষণœতার মধ্যেও আল্পনা সবুজের উপস্থিতি সাবলীলভাবে নিয়েছিল এবং এতক্ষণে যথেষ্ঠ স্বতোস্ফূর্তও হয়েছে। আল্পনা শিল্পপ্রাণ মানুষ কাজেই সে কখনো বিষণœ হয়ে পড়লে তার শিল্পময়তার মধ্যে সেই বিষণœতা হারিয়ে যায। এই কথাটি তার ছোটবোন সানজিদা একবার তাকে বলেছিল। কথাটি তার যথার্থ মনে হয়। সে ভাবে এরকম ব্যপারগুলোই সাধারণত মানুষ মিস্ করে বেশি। সবুজকে তার বেশ বেশ একজন বিশ্বস্ত সরল মানুষ বলেই মনে হলো। সে আরো চিন্তা করে সবুজ কী এরকম কোন বিষয় ধরেই তার সাথে গল্প শুরু করেছে নাকি আদৌ ব্যপারটির দিকে কোন নজরই দেয়নি। সবুজ খানিক সময়ের জন্য সমুদ্রের দিকে আনমনা হয়ে গিয়েছিল। আল্পনার কথায় সে আবারো মনযোগি হয়। আল্পনা বলে...
Ñআপনি মাজারে প্রথম এসেছেন। আপনাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য আমি দিতে পারি। শুনে আপনার খারাপ লাগবে। বিষয়টি মর্মান্তিক একটি ঘটনা কিন্তু আমার মনে হয় ব্যপারটি আপনাকে জানালেও খারাপ হবে না। তার আগে আবার আমরা এককাপ চা খেয়ে নিতে পারি। আপনার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাকলে আপনি সিগারেটও খেতে পারেন। কিছু কিছু ছেলেদের সিগারেট খাওয়ার দৃশ্যটি আমার কাছে অদ্ভুত মজার মনে হয়। মনে হয় তারা যেন কোন বিশেষ স্বপ্নে ভিতর আগুনের নিঃশ্বাষ নিচ্ছে। আপনার কাছে একটা বিশেষ রিকোয়েস্ট থাকবে। যে ঘটনাটি আমি বলবো না বুঝে তা কারো কাছে প্রকাশ করবেন না। সবুজ জানায়, তা না হয় প্রকাশ করবো না কিন্তু ঘটনাটি কী সেটা আগে শুনি।
এখানকার মোহিনীমোহন বিশ্ববিদ্যালয় তখনো সরকারিকরণ করা হয়নি। কল্যাণী দাশ রুক্সা নামে একজন তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন পরপর দু-টার্মের ভি.পি। শুধুমাত্র ছাত্র নেতৃত্বই নয় তিনি ছিলেন স্থানীয় একজন সফল পত্রিকা ব্যবসায়ী। সুসাং সমাচারের সম্পাদক ও প্রকাশক। ছবিও আঁকতেন মাঝেমধ্যে। অসম্ভব জনপ্রিয় এই নেত্রী ছিলেন উদারনৈতিক এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন সুন্দর মনের মানুষ। তার নেতৃত্বেই মোহিনীমোহন কলেজটি সরকারিকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। সমস্যাটা শুরু হয়েছিল ওখান থেকেই। সে সময় তার বিরোধি পক্ষের একজন প্রভাবশালি নেতা রাধাকান্ত ঠাকুর ও তার বিদ্রোহি একটি গ্র“প কলেজটি সরকারিকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার ব্যপারে ঘোর আপত্তি তোলে। সেইসংগে তারা বিপরীত আন্দোলনের ডাক দেয়। কলেজটি সরকারিকরণ করা হলে তাদের ঘৃণ্য রাজনীতি চরিতার্থ করা সম্ভব হবে না বলেই তারা অপরাজনীতির তৎপরতা চালান। তারা সফলকাম হতে না পেরে একসময় কল্যাণী দাশ রুক্সাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং গণধর্ষণের এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রুক্সাকে হত্যা করে এই দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলে ফেলে দেয়। পরে রুক্সার মৃতদেহটি আবিস্কার করেন স্থানীয় প্রভাবশালি একজন কবিরাজ শাহ আলী ফকির। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে এমনটি ঘটেছে তা অনেকেরই জানার বাকি ছিল না। মৃতদেহটি সনাক্ত করণের পর কবিরাজ শাহ আলী ফকির অনুভব করলেন পরবর্তি পরিস্থিতি। লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে শাহ আলী ফকিরসহ তার সকল ভক্তকুলের ক্ষতি হতে পারে। অপরদিকে লাশ সনাক্ত করে ফেলে যাওয়া তার মূল্যবোধের অন্তরায়। ফলে তিনি তার সকল ভক্তদের খবর দিয়ে আস্তানায় ডেকে আনেন এবং সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় এর একটা সমাধান তৈরি করেন। রুক্সার ঘটনাটি আরো বড় সহিংসতার দিকে যেতে পারে। এই সকল ব্যপার এড়িয়ে যাবার জন্য রুক্সাকে তিনি তপদায়ী বিবি নতুন নাম দেন সেইসঙ্গে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে লাশ সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন। তপদায়ী বিবির কবরস্থানেই তিনি মাজার শরীফ করার প্ল্যান তৈরি করে কয়েকজন খাদেম নিযুক্ত করে দেন কবর পরিচর্যার জন্য। তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত আজকের তপদায়ী বিবির মাজার। সবুজ মনযোগ দিয়ে শুনছিল ঘটনাটি। সবুজ বুঝতে পেরেছে সামাজিক প্রাচীন ধারণায় আমরা যেরকম বিষয়গুলি ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার বলে থাকি রুক্স্রার এই ঘটনাটি তেমনি এক ভাগ্যবিড়ম্বনার ইতিহাস। বাস্তবিক তুখোড় একজন ছাত্রনেতা তার মৃত্যুর পর মানুষের মানবিক মূল্যবোধের থেকে রেহাই পেলেন কিনা সন্দিহান হয়ে পড়ে সবুজ। মাজার বিষয়ে তার ধর্মানুভূতিটি স্বাভাবিক একটু পরিবর্তিত হয়। সে আল্পনাকে জিজ্ঞেশ করে...
—এসব জানার পর আপনার মাজারে আসার কী আরো কোনো কারণ ছিল?
—আল্পনা জানায়, আছে। সবই বলবো আপনাকে তার আগে বলি, কবিরাজ শাহ আলী ফকির মৃত্যুর পূর্বে আরো একটি চমৎকার কাজ করে গেছেন। মাজারটির আধুনিক নির্মাণের সময় মূলঘর বা কবরস্থানের চারপাশে যেখানে দেয়াল করা হয়েছে সেখানে নাকি টাইলস্ করে বসানো হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপর রুক্সার করা বেশকিছু দুর্লভ সেরিগ্রাফ। দীর্ঘ প্ল্যানিঙের পর শাহ আলী ফকির রুক্সার পরিবারে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে চিত্রগুলো সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। শুনেছি মাজার ভবন নির্মাণের ব্যপারে মামুন স্যারেরও ভূমিকা আছে। মূলঘরে টাইলস্ বসানোর জন্য তিনি নেপাল থেকে শিল্পী নিয়ে আসতে সহযোগিতা করেছিলেন।
—যে সেরিগ্রাফগুলো বসানো হয়েছে সেগুলো কী আপনি দেখেছেন?
—না। মাজারের মূলঘরে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চেষ্টা করছি কোনো বিশেষ প্রক্রিয়ায় সেই সেরিগ্রাফগুলো দেখা যায় কিনা।
—সবুজ বলে, আপনার শিল্প চেতনায় সেগুলো বিশেষ কাজে লাগতে পারে। আচ্ছা, একটা বিষয় আপনি চিন্তা করেছেন কী? যে কথাগুলো আপনি আমাকে জানালেন এই তথ্যগুলোর উপর নির্ভর করে তো একটি উপন্যাসও লিখতে পারেন। আমি দেখেছি এরকম ঐতিহাসিক সত্যাসত্যের উপর লিখিত উপন্যাসগুলোই আমাদের দেশে খাঁটি উপন্যাস হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
—আরো প্রকৃত তথ্য এবং ইতিহাস জানা হলে এর উপর আমার একটি উপন্যাস লেখা এবং চলচিত্র নির্মাণের বিশেষ ইচ্ছে আছে আল্পনা জানায়।
বিকেলের গোধূলিলগ্ন পেরিয়ে সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। আজকের গোধূলিলগ্নটি একটু অন্যরকম মনে হয়েছে। ঠিক সকালের ধল প্রহরের মতোই যেন স্থবির গোধূলি সবুজ আল্পনাকে এক জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আল্পনাকে চলে যেতে হবে হোস্টেলে। রাত নটার মধ্যে না পৌঁছালে হোস্টেলে প্রবেশ করা তার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া এইসব মহিলা হোস্টেলে রাত করে ফেরাদের বাড়তি বিড়ম্বনা ফেস করতে হয় পরিচিত জনদের অহেতু ব্যাঙ্গাত্মক ঠেস দেয়া কিছু প্রশ্নের। কিরে লুকিয়ে কোথাও প্রেম করছিস নাকি? শুনলাম চাকরি পেয়ে গেছিস মিষ্টি তো খাওয়ালি না দোস্ত? হোস্টেল ছেড়ে দিবি কবে থেকে? ইত্যাদি, অহেতু কিছু প্রশ্ন আল্পনার কাছে খুবই বিরক্তিকর। তাই সে সবুজ কে জানায়, সন্ধ্যা হয়ে এলো আমাকে এখনই হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে। আপনার সংগে দেখা হবে। কথা হবে আরো।
—সবুজ বলে, যেহেতু আপনি হোস্টেলে থাকেন ফিরে তো যেতেই হবে। কিন্তু যাবার সময় আরো একটি বিষয় আপনার কাছে জানতে চাওয়া। আপনি কী কোন রাজনীতির সংগে জড়িত আছেন? মাজারের সবুজ ঘাস আর মাটির উপর হাতের ভর দিয়ে বসেছিল দুজন। কী ভেবে ভয়ের সংগেই যেন আল্পনা সবুজের হাত চেপে ধরে।
—না। আমি কোন প্রত্যক্ষ রাজনীতি করি না। মনেপ্রাণে আমি একজন শিল্পচেতনার মানুস। শিল্প ভালোবাসি। তবে মনে করতে পারেন আমি একজন নারীবাদী চেতনার মানুষ। সভ্যতা সৃষ্টির পর থেকে নারীদের সকল সৃষ্টিশীলতার ইতিহাস, তাদের উপর নির্যাতন, স্ট্রাগল, আমাকে স্পর্শ করে। দুঃখ দেয়। পাশাপাশি তাদের উদ্দিপনা, উৎসাহ, প্রেরণা এইসবই আমি আমার শিল্পচেতনায় ধারণ করতে চাই। ধল পহরের আলোয় আল্পনা সবুজের মুখের দিকে তাকায়। শিল্পযাত্রায় অনেকটা পথ আমাকে পাড়ি দিতে হবে। সেই যাত্রায় আপনি আমার সহযাত্রী হবেন? কথার ফাঁকেই সবুজ লক্ষ করেছে আল্পনার শিশুর সারল্যবোধ। সে কিছু একটা আঁচ করতে পেরে নিজের মধ্যেই তা চেপে রাখলো। বিষণœ সবুজের মনের মধ্যেও একটু কাব্য খেলা করলো। তাই সে একটু কাব্যিক প্রকাশের আশ্রয় নিলো। সে বললো...
—চন্দ্র-সূর্য প্রবহমান সমান্তরাল। দুজনই ছুটছে তাদের নিজস্ব গতিতে। তারা একে অপরের সহযাত্রী কিনা আমার জানা নাই। আপনার শিল্পযাত্রায় আমি সহযাত্রী হতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হবে। আপনার হোস্টেলে ফেরার সময় হয়ে গেছে। আমি কী আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে পারি?
—আল্পনা বলে, এগিয়ে দিয়ে আসতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো। সবুজ আল্পনার মোবাইল নাম্বারটি দিতে বললে সে তার পার্স থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে অপরপিঠে তার নাম্বারটি লিখে দিয়ে বলে সেভ করে নিন। আগামীকাল আপনি যে ভাইবা দিতে যাবেন সেই প্রতিষ্ঠান এসডিএফ এর ডিরেক্টর আমার চাচা। যাবার সময় একটু যেন রসিকতা করে আল্পনা। ভাইবার আগে সেভ করে যায়েন কিন্তু সেইসাথে ফেসিয়াল করে নেবেন। ৩ দিনের সমুদ্রের হাওয়ায় আপনার চেহারা একটু কালোমতো হয়ে গেছে, তা কেটে যাবে।
----------