Monday, January 30, 2023

সেরিগ্রাফ

তপদায়ী বিবির বিস্কুট না খেলে মানুষের অমঙ্গল হয়। এটাই নিয়ম, এখানকার মানুষজন বলে থাকে। বিবি সাহেবার মাজারটি দেখতে ভীষণ সুন্দর। দূর থেকে দেখলে বোঝা যায়। দুটি বৃহৎ পাহাড়ের বেস্টনিতে এক রাজবাড়ি যেন। সমুখেই অসীম সমুদ্রের উথাল পাথাল বিশাল ঢেউয়ের গর্জন। প্রকৃতির এই অপার জলরাশিই বিবি সাহেবার মাজারকে বিশেষ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। তাই মাজারে আসা সকলেই যে শুধু মানতের জন্যই আসেন এমন নয় কেউ কেউ আসেন অপার জলের এই লীলার মাঝে নিজের ক্ষুদ্র বিষণœ গণ্ডোলাটি পরখ করে নিতে, আদতেই সেটি বিশ্বলীলায় সচল কোনো বান্ধব হয়ে ওঠে কিনা। কখনোই সম্ভব নয়। সমুদ্র বিশাল। মানুষের চিন্তার চেয়েও অনেক বড়। বিশাল জলরাশির দিকে তাকিয়ে এমনই একটি চিন্তার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল সবুজ। তার মনযোগ ভাঙে বিশাল জলরাশির দিকে ছুঁড়ে দেয়া প্যাকেটভর্তি মিষ্টির ঘটনায়। মিষ্টির প্যাকেটটি জলের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে একটি মেয়ে। তিনদিন হয় সবুজ মাজারে এসেছে। সমুদ্রের হাওয়ায় ওর চেহারায় কালোমতো এক ধরনের ছাপ পড়েছে। সবুজ দেখছে মেয়েটির চেহারায় তেমনি এক বিষণœতা গ্রাস করে রেখেছে। কিছু জিজ্ঞেশ করবে ভেবে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায় সবুজ। সে সমুদ্রের জলরাশির দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে গলায় হালকা কাশির আওয়াজে জিজ্ঞেশ করে সবুজ, কিছু মনে করবেন না একটা প্রশ্ন করতে পারি? অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকায় মেয়েটি, জ্বী, আপনি? প্রশ্ন করে আল্পনা।

—আমি জিহাদ করিম সবুজ। গত তিনদিন হলো মাজারে এসেছি। আজকেই আপনাকে মাজারে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। আপনার সাথে পরিচিত হতে পারলে ভালো লাগতো।
—আমি আল্পনা শিকদার। ছবি আঁকি। আপনি কিছু জিজ্ঞেশ করতে চেয়েছিলেন।
—একটু আগেই দেখলাম আপনার হাতে একটি মিষ্টির প্যাকেট ছিল। সমুদ্রের জলে তা ফেলে দিয়েছেন। এটা কেন করলেন, কোনো কারণে মন খারাপ হয়েছে নিশ্চয়?
—আসলে মিষ্টিগুলো মাজারের কবরষাঁড়ের জন্য মানত করে নিয়ে এসেছিলাম। খায়নি তো তাই সমুদ্রেই ফেলে দিলাম।
সবুজ বুঝতে পেরেছে কবরঘড়ের ষাঁড় মিষ্টিগুলো খায়নি বলে আল্পনার মন একটু খারাপ হয়েছে। সেও ষাঁড়ের জন্য এককাদি কলা নিয়ে এসেছিল। খেয়েছে। মাজারের ষাঁড় কিছু খেলে মানুষের মানত পূর্ণ হয়। কারো প্রত্যক্ষ আবার কারো অবচেতনেই পূর্ণ হয়। কিন্তু ক্ষতি হয় কিনা সবুজের জানা নেই। সে আল্পনাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে। মানুষের জীবনটা একটা ঝাপসা আয়না। কখনো নিজেকে স্পষ্ট দেখা যায় আবার কখনো দেখা যায় না। তবু মানুষ বিশেষ অন্বেষায় বারবার নিজেকে স্বচ্ছ আয়নার মতো দেখতে চায়। মন খারাপ করবেন না। এবার ষাঁড় মানত খায়নি কিন্তু আগামীবার তো খেতে পারে। আল্পনারও এরকমই বিশ্বাস। সে বহুবার মাজারে এসেছে, মানত এনেছে কিন্তু এবারই প্রথম কবরষাঁড় তার মানত খায়নি। বিশেষ প্রত্যাশা করে সে এবার নেত্রকোণার বিখ্যাত মিষ্টি কিছু বালিশ আনিয়েছিল কবরষাঁড়ের জন্য।
তপদায়ী বিবির মাজারের তবারক না খেলে মানুষের অমঙ্গল হয়। আর খেলে মন ভালো হয়ে যায়। সেই তবারক বিস্কুট বিতরণ শুরু হয়েছে। সবুজ, আল্পনা বসে আছে সমুদ্রের দিকে চেয়ে। খেদমতকারীরা বিস্কুট দিয়ে গেছে। তবারক খেতে খেতে আল্পনা সবুজের কাছে জানতে চায়, অনেকক্ষণ আমরা কথা বলে চলেছি কিন্তু আপনার সম্পর্কে ভালো করে জানা হলো না।
—আপনার হোম ডিস্ট্রিক্ট কোথায়? কী করছেন?
—রাজশাহী। কিছু করার কথা আসলে আপনাকে বলতে পারবো না। দর্শনে মাস্টার্স শেষ করেছি ৫/৬ বছর হয়ে গেলো। চাকরি হয় না। ২৭টা সিভি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোথাও ভালো কোনো রেসপন্স নাই। বলতে পারেন বেকার। মাঝেমধ্যে গানের কথা লেখার চেষ্টা করি।
—আপনি তাহলে গীতিকার। বাহ্ খুবই চমৎকার মনের মানুষ আপনি। আপনার সাথে আরো কথা বলতে পারলে আমারও ভালো লাগতো।
—গীতিকার হলেই যে চমৎকার মনের মানুষ হয় এমন নয়। তবে নিজেকে একজন চমৎকার মনের মানুষ হিসেবে ফিল করি মাঝেমধ্যে। তাতে কী হয়? আমাদের জ্ঞানের পরিধি এত দুর্বল যে সঠিক বিবেচনায় আমরা যা ভালো চিন্তা করি মনে করে ধরি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হিতে বিপরীত ধারণার। নিজের দুর্বলতাকে আমরা বর্জন করে চলতে পারি না। তবু তো কখনো সখনো আমাদের মাঝে চমৎকার মনের মানুষ মিলে। কথা আরো বলা যায়। চলেন তার আগে আমরা এককাপ চা খেয়ে আবারো এখানে এসে বসি।
—দারুণ মজার কথা বলেছে আপনি, ঠিকাছে চলেন। চা খাওয়ার পর আপনার লেখা গানের কথাগুলো শুনবো। সম্ভব হলে একটু গেয়েও শোনাবেন।
একটাই আকাশ অসীম আকাশ আকাশটাকে দেখি
আকাশভরা লক্ষ তারার মেলা
একটি তারা আমার কথা, একটি তারা কবিতা যেন
একটি তারা গান
কাচের গুঁড়ো তোমার চুড়ি
বেলকনিতে হৃদয়ের গল্প শূন্যতা খানখান।
—বাহ্ খুবই চমৎকার। অসম্ভব সুন্দর একটি গান লিখেছেন আপনি। কথাগুলো শুনতে শুনতে ছবির মতো একটি কবিতার ঘোরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের শিল্পবোধ আসলে খুবই সাধারণ কিন্তু সকল মানুষ তা সহজে বুঝতে চায় না। প্রথমে আমিও বুঝতাম না। খুব সাধারণ একটি বিষয় মনে পড়ছে আপনাকে বলি। চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর প্রথম দিনেই আমরা ক্লাশে পেয়েছিলাম ঢালি আল মামুন স্যারকে। অসামান্য একজন শিল্পী অসামান্য তাঁর শৈল্পিক নান্দনিকতা। প্রথমেই আমার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন তাঁর নান্দনিক প্রজ্ঞায়। ক্লাশে সকলেরই একটি করে ছবি আঁকার কথা ছিল। কেউ কেউ সফল হলেও সেদিন আমি কোন ছবি আঁকতে পারছিলাম না। শুধু একটি ফিগার আঁকার চেষ্টা করেছিলাম তাও হয়নি। মামুন স্যার খুব সহজেই এঁকে দেখালেন। একটি সরল ছবিও কীরকম অসাধারণ নান্দনিকবোধে ফুটে উঠতে পারে। পানির উপর ভাসছে একটি শুকনো মলিন পাতা তার নিচে মেলে ধরা হাতের পাঁচটি আঙুল। সূর্যকিরণ পড়ছে পানিতে। খুবই সুন্দর চিত্রকল্প, তাই না? গানের ব্যপারটাও আমার কাছে তেমনই সঞ্চারণশীল বিষয় বলে মনে হয় কিন্তু সাধারণ মানুষের ধারণা এবং আবেগটা আমার কাছে পরিষ্কার হয় না। আল্পনা আবার অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকায় সবুজের দিকে। আচ্ছা আপনি মাজারে কেন এসেছেন সেটা তো জানা হলো না।
—আসলে মাজারে আসিনি আমি। সবুজ বলে। স্যোসাল ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এসডিএফ) একটি প্রজেক্টে নিয়োগের জন্য এখানে ডেকেছে আমাকে। আগামীকাল ভাইবা অনুষ্ঠিত হবে। সেজন্য এসেছি। আল্পনা আবার অদ্ভুত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকায়। সবুজ দেখে বিষণ্ন মলিনতায়ও আল্পনার চোখে এক ধরনের সহাস্যবদন দৃষ্টি। এখানে আসার পূর্বে আমার পরিচিত একজন বিবি সাহেবার মাজারের কথা বলেছে। বলেছে সহিদিলে মাজারে কোন মানত করলে তা পূর্ণ হয়। সেজন্যও এসেছি। এসে দেখলাম মাজারটি দেখতেও ভীষণ সুন্দর। আর আপনার সাথে দেখা হওয়াতে আরো বেশি ভালো লাগছে।
আল্পনা বলে মাজারে এসে আমার একটা বিশেষ লাভ হয়েছে, জানেন?
—কী লাভ হয়েছে বলেন তো শুনি।
আল্পনা তার শিটহোল্ডারের ভিতর থেকে ভাঁজকরা আর্টপেপার খুলে একটি ষাঁড়ের ছবি দেখায়। খুবই সুন্দর ক্ষীপ্র একটি ষাঁড়ের তেজি ভঙ্গির ছবি। মাজারে আসার পর কবরষাঁড়টি দেখে আমি এই ছবিটি আঁকার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। মাজারের কবরঘরে মানুষের বন্দি সেই ষাঁড়টিরই একটি বিপরীত গতিময়তাই আমি এই ছবিটিতে ধরতে চেয়েছি।
সবুজ কিছুক্ষণ ছবিটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে পর্যবেক্ষণ করে। লাল-সবুজ রঙের অপূর্ব মিশ্রণের মাঝে গাঢ় কালোরঙে ষাঁড়টি খুব সুন্দর দেখায়। তারপর বলে...
—খুবই সুন্দর ছবি। ছবিটি কী আপনার কোনো প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে?
Ñনা। ছবিটি আমার সাম্প্রতিক আঁকা। এশিয়ান ত্রিদেশিয় একটি চারুকলা প্রদর্শনীতে আমার অন্য তিনটি ছবি স্থান পেয়েছিল।
—আপনার পরবর্তি প্রদর্শনীতে এই ছবিটি রাখবেন। আমার অনুরোধ। খুবই সুন্দর ছবি।
—আল্পনা বলে, আমার পছন্দের একটি বিশেষ ছবি এটি। আপনি না বললেও চবিটি আমার পরবর্তি প্রদর্শনীতে আমি রাখতাম। ছবিটি আপনার কাছে সুন্দর লেগেছে বলে আপনাকে স্পেশাল থ্যাঙ্কস্। প্রদর্শনী হলে আপনার কথা আমার মনে পড়বে। প্রদর্শনীর সময় আপনি নিজে উপস্থিত থাকলে, আপনি যদি আমার প্রদর্শনী দেখতে আসেন তাহলে আরো বেশি খুশি হবো।
—সবুজ জানায়, যদি বেঁচে থাকি আপনি জানালে আমি অবশ্যই প্রদর্শনী দেখতে আসবো। থাকতে পারলে আমারও ভালো লাগবে।
আল্পনার চেহারার মলিনতা প্রায় কেটে গেছে। খানিক পূর্বেই যে কালো ছায়া তাকে গ্রাস করে রেখেছিল তা এখন আর নেই। বিষণœতার মধ্যেও আল্পনা সবুজের উপস্থিতি সাবলীলভাবে নিয়েছিল এবং এতক্ষণে যথেষ্ঠ স্বতোস্ফূর্তও হয়েছে। আল্পনা শিল্পপ্রাণ মানুষ কাজেই সে কখনো বিষণœ হয়ে পড়লে তার শিল্পময়তার মধ্যে সেই বিষণœতা হারিয়ে যায। এই কথাটি তার ছোটবোন সানজিদা একবার তাকে বলেছিল। কথাটি তার যথার্থ মনে হয়। সে ভাবে এরকম ব্যপারগুলোই সাধারণত মানুষ মিস্ করে বেশি। সবুজকে তার বেশ বেশ একজন বিশ্বস্ত সরল মানুষ বলেই মনে হলো। সে আরো চিন্তা করে সবুজ কী এরকম কোন বিষয় ধরেই তার সাথে গল্প শুরু করেছে নাকি আদৌ ব্যপারটির দিকে কোন নজরই দেয়নি। সবুজ খানিক সময়ের জন্য সমুদ্রের দিকে আনমনা হয়ে গিয়েছিল। আল্পনার কথায় সে আবারো মনযোগি হয়। আল্পনা বলে...
Ñআপনি মাজারে প্রথম এসেছেন। আপনাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য আমি দিতে পারি। শুনে আপনার খারাপ লাগবে। বিষয়টি মর্মান্তিক একটি ঘটনা কিন্তু আমার মনে হয় ব্যপারটি আপনাকে জানালেও খারাপ হবে না। তার আগে আবার আমরা এককাপ চা খেয়ে নিতে পারি। আপনার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাকলে আপনি সিগারেটও খেতে পারেন। কিছু কিছু ছেলেদের সিগারেট খাওয়ার দৃশ্যটি আমার কাছে অদ্ভুত মজার মনে হয়। মনে হয় তারা যেন কোন বিশেষ স্বপ্নে ভিতর আগুনের নিঃশ্বাষ নিচ্ছে। আপনার কাছে একটা বিশেষ রিকোয়েস্ট থাকবে। যে ঘটনাটি আমি বলবো না বুঝে তা কারো কাছে প্রকাশ করবেন না। সবুজ জানায়, তা না হয় প্রকাশ করবো না কিন্তু ঘটনাটি কী সেটা আগে শুনি।
এখানকার মোহিনীমোহন বিশ্ববিদ্যালয় তখনো সরকারিকরণ করা হয়নি। কল্যাণী দাশ রুক্সা নামে একজন তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন পরপর দু-টার্মের ভি.পি। শুধুমাত্র ছাত্র নেতৃত্বই নয় তিনি ছিলেন স্থানীয় একজন সফল পত্রিকা ব্যবসায়ী। সুসাং সমাচারের সম্পাদক ও প্রকাশক। ছবিও আঁকতেন মাঝেমধ্যে। অসম্ভব জনপ্রিয় এই নেত্রী ছিলেন উদারনৈতিক এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন সুন্দর মনের মানুষ। তার নেতৃত্বেই মোহিনীমোহন কলেজটি সরকারিকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। সমস্যাটা শুরু হয়েছিল ওখান থেকেই। সে সময় তার বিরোধি পক্ষের একজন প্রভাবশালি নেতা রাধাকান্ত ঠাকুর ও তার বিদ্রোহি একটি গ্র“প কলেজটি সরকারিকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার ব্যপারে ঘোর আপত্তি তোলে। সেইসংগে তারা বিপরীত আন্দোলনের ডাক দেয়। কলেজটি সরকারিকরণ করা হলে তাদের ঘৃণ্য রাজনীতি চরিতার্থ করা সম্ভব হবে না বলেই তারা অপরাজনীতির তৎপরতা চালান। তারা সফলকাম হতে না পেরে একসময় কল্যাণী দাশ রুক্সাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং গণধর্ষণের এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রুক্সাকে হত্যা করে এই দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলে ফেলে দেয়। পরে রুক্সার মৃতদেহটি আবিস্কার করেন স্থানীয় প্রভাবশালি একজন কবিরাজ শাহ আলী ফকির। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে এমনটি ঘটেছে তা অনেকেরই জানার বাকি ছিল না। মৃতদেহটি সনাক্ত করণের পর কবিরাজ শাহ আলী ফকির অনুভব করলেন পরবর্তি পরিস্থিতি। লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে শাহ আলী ফকিরসহ তার সকল ভক্তকুলের ক্ষতি হতে পারে। অপরদিকে লাশ সনাক্ত করে ফেলে যাওয়া তার মূল্যবোধের অন্তরায়। ফলে তিনি তার সকল ভক্তদের খবর দিয়ে আস্তানায় ডেকে আনেন এবং সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় এর একটা সমাধান তৈরি করেন। রুক্সার ঘটনাটি আরো বড় সহিংসতার দিকে যেতে পারে। এই সকল ব্যপার এড়িয়ে যাবার জন্য রুক্সাকে তিনি তপদায়ী বিবি নতুন নাম দেন সেইসঙ্গে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে লাশ সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন। তপদায়ী বিবির কবরস্থানেই তিনি মাজার শরীফ করার প্ল্যান তৈরি করে কয়েকজন খাদেম নিযুক্ত করে দেন কবর পরিচর্যার জন্য। তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত আজকের তপদায়ী বিবির মাজার। সবুজ মনযোগ দিয়ে শুনছিল ঘটনাটি। সবুজ বুঝতে পেরেছে সামাজিক প্রাচীন ধারণায় আমরা যেরকম বিষয়গুলি ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার বলে থাকি রুক্স্রার এই ঘটনাটি তেমনি এক ভাগ্যবিড়ম্বনার ইতিহাস। বাস্তবিক তুখোড় একজন ছাত্রনেতা তার মৃত্যুর পর মানুষের মানবিক মূল্যবোধের থেকে রেহাই পেলেন কিনা সন্দিহান হয়ে পড়ে সবুজ। মাজার বিষয়ে তার ধর্মানুভূতিটি স্বাভাবিক একটু পরিবর্তিত হয়। সে আল্পনাকে জিজ্ঞেশ করে...
—এসব জানার পর আপনার মাজারে আসার কী আরো কোনো কারণ ছিল?
—আল্পনা জানায়, আছে। সবই বলবো আপনাকে তার আগে বলি, কবিরাজ শাহ আলী ফকির মৃত্যুর পূর্বে আরো একটি চমৎকার কাজ করে গেছেন। মাজারটির আধুনিক নির্মাণের সময় মূলঘর বা কবরস্থানের চারপাশে যেখানে দেয়াল করা হয়েছে সেখানে নাকি টাইলস্ করে বসানো হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপর রুক্সার করা বেশকিছু দুর্লভ সেরিগ্রাফ। দীর্ঘ প্ল্যানিঙের পর শাহ আলী ফকির রুক্সার পরিবারে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে চিত্রগুলো সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। শুনেছি মাজার ভবন নির্মাণের ব্যপারে মামুন স্যারেরও ভূমিকা আছে। মূলঘরে টাইলস্ বসানোর জন্য তিনি নেপাল থেকে শিল্পী নিয়ে আসতে সহযোগিতা করেছিলেন।
—যে সেরিগ্রাফগুলো বসানো হয়েছে সেগুলো কী আপনি দেখেছেন?
—না। মাজারের মূলঘরে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চেষ্টা করছি কোনো বিশেষ প্রক্রিয়ায় সেই সেরিগ্রাফগুলো দেখা যায় কিনা।
—সবুজ বলে, আপনার শিল্প চেতনায় সেগুলো বিশেষ কাজে লাগতে পারে। আচ্ছা, একটা বিষয় আপনি চিন্তা করেছেন কী? যে কথাগুলো আপনি আমাকে জানালেন এই তথ্যগুলোর উপর নির্ভর করে তো একটি উপন্যাসও লিখতে পারেন। আমি দেখেছি এরকম ঐতিহাসিক সত্যাসত্যের উপর লিখিত উপন্যাসগুলোই আমাদের দেশে খাঁটি উপন্যাস হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
—আরো প্রকৃত তথ্য এবং ইতিহাস জানা হলে এর উপর আমার একটি উপন্যাস লেখা এবং চলচিত্র নির্মাণের বিশেষ ইচ্ছে আছে আল্পনা জানায়।
বিকেলের গোধূলিলগ্ন পেরিয়ে সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। আজকের গোধূলিলগ্নটি একটু অন্যরকম মনে হয়েছে। ঠিক সকালের ধল প্রহরের মতোই যেন স্থবির গোধূলি সবুজ আল্পনাকে এক জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আল্পনাকে চলে যেতে হবে হোস্টেলে। রাত নটার মধ্যে না পৌঁছালে হোস্টেলে প্রবেশ করা তার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া এইসব মহিলা হোস্টেলে রাত করে ফেরাদের বাড়তি বিড়ম্বনা ফেস করতে হয় পরিচিত জনদের অহেতু ব্যাঙ্গাত্মক ঠেস দেয়া কিছু প্রশ্নের। কিরে লুকিয়ে কোথাও প্রেম করছিস নাকি? শুনলাম চাকরি পেয়ে গেছিস মিষ্টি তো খাওয়ালি না দোস্ত? হোস্টেল ছেড়ে দিবি কবে থেকে? ইত্যাদি, অহেতু কিছু প্রশ্ন আল্পনার কাছে খুবই বিরক্তিকর। তাই সে সবুজ কে জানায়, সন্ধ্যা হয়ে এলো আমাকে এখনই হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে। আপনার সংগে দেখা হবে। কথা হবে আরো।
—সবুজ বলে, যেহেতু আপনি হোস্টেলে থাকেন ফিরে তো যেতেই হবে। কিন্তু যাবার সময় আরো একটি বিষয় আপনার কাছে জানতে চাওয়া। আপনি কী কোন রাজনীতির সংগে জড়িত আছেন? মাজারের সবুজ ঘাস আর মাটির উপর হাতের ভর দিয়ে বসেছিল দুজন। কী ভেবে ভয়ের সংগেই যেন আল্পনা সবুজের হাত চেপে ধরে।
—না। আমি কোন প্রত্যক্ষ রাজনীতি করি না। মনেপ্রাণে আমি একজন শিল্পচেতনার মানুস। শিল্প ভালোবাসি। তবে মনে করতে পারেন আমি একজন নারীবাদী চেতনার মানুষ। সভ্যতা সৃষ্টির পর থেকে নারীদের সকল সৃষ্টিশীলতার ইতিহাস, তাদের উপর নির্যাতন, স্ট্রাগল, আমাকে স্পর্শ করে। দুঃখ দেয়। পাশাপাশি তাদের উদ্দিপনা, উৎসাহ, প্রেরণা এইসবই আমি আমার শিল্পচেতনায় ধারণ করতে চাই। ধল পহরের আলোয় আল্পনা সবুজের মুখের দিকে তাকায়। শিল্পযাত্রায় অনেকটা পথ আমাকে পাড়ি দিতে হবে। সেই যাত্রায় আপনি আমার সহযাত্রী হবেন? কথার ফাঁকেই সবুজ লক্ষ করেছে আল্পনার শিশুর সারল্যবোধ। সে কিছু একটা আঁচ করতে পেরে নিজের মধ্যেই তা চেপে রাখলো। বিষণœ সবুজের মনের মধ্যেও একটু কাব্য খেলা করলো। তাই সে একটু কাব্যিক প্রকাশের আশ্রয় নিলো। সে বললো...
—চন্দ্র-সূর্য প্রবহমান সমান্তরাল। দুজনই ছুটছে তাদের নিজস্ব গতিতে। তারা একে অপরের সহযাত্রী কিনা আমার জানা নাই। আপনার শিল্পযাত্রায় আমি সহযাত্রী হতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হবে। আপনার হোস্টেলে ফেরার সময় হয়ে গেছে। আমি কী আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে পারি?
—আল্পনা বলে, এগিয়ে দিয়ে আসতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো। সবুজ আল্পনার মোবাইল নাম্বারটি দিতে বললে সে তার পার্স থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে অপরপিঠে তার নাম্বারটি লিখে দিয়ে বলে সেভ করে নিন। আগামীকাল আপনি যে ভাইবা দিতে যাবেন সেই প্রতিষ্ঠান এসডিএফ এর ডিরেক্টর আমার চাচা। যাবার সময় একটু যেন রসিকতা করে আল্পনা। ভাইবার আগে সেভ করে যায়েন কিন্তু সেইসাথে ফেসিয়াল করে নেবেন। ৩ দিনের সমুদ্রের হাওয়ায় আপনার চেহারা একটু কালোমতো হয়ে গেছে, তা কেটে যাবে।
----------

Sunday, September 27, 2009

জোসেফ সাংমার না লেখা গল্প

বেশ কিছুদিন যাবৎ ভোরবেলা আতংকিত হয়ে ঘুম ভাঙে জোসেফের। এমনটি হবার কারণ সে খুঁজে বের করেছে আজ... কিছুদিন পূর্বে সে গ্রেগর সামসার পোকা হয়ে যাওয়ার কাহিনীটি পড়েছে এবং জেনেছে যে, হঠাৎ একদিন গ্রেগর সামসা ঘুম থেকে জেগে দেখেন তিনি পোকায় পরিণত হয়েছেন। জোসেফেরও মনে হচ্ছিল যে, হঠাৎ তিনিও কোনদিন ঘুম থেকে জেগে দেখবেন তার দুটো মাথা হয়ে গেছে কিংবা হাতদুটো পশ্চাতের দিকে একেবারে নিতম্বের কাছাকাছি ঝুলছে অথবা চোখ দুটো বুকের দুই স্তনবৃন্তে মিটমিট করছে আবার এও হয়ে যেতে পারে যে, তার লিঙ্গটি এবং সমস্ত বস্তি এলাকা চলে এসেছে ঠিক কপালের মাঝখানে (নিতান্তই প্রকৃতি বিরুদ্ধ কল্পনা)। অবশ্য বিষয়টি তার পুরোপুরি বিশ্বাস হয় না কেননা এমন ঘটনা মনুষ্য প্রজাতিতে কখনো দেখা গেছে বলে শুনেনি। বিজ্ঞান যদি কোনোভাবে বিষয়টি সত্য বলে কখনো প্রমাণ করতে পারে তবে তার বিশ্বাস হবে।
জোসেফ সাংমা একজন লেখক, মূলত সে উপজাতিয়। আমাদের উত্তরাঞ্চলে উপজাতিয়দের মধ্যে একজন লেকক আছেন এটি বিষ্ময়কর একটি বিষয়! কেননা এ অঞ্চলে উপজাতিয়দের মধ্যে ইতিপূর্বে কোনো লেখক ছিলেন বলে শুনিনি। এ অঞ্চলে উপজাতিয়দের মধ্যে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন কোনো লেখক না থাকার সম্ভাবনাই বেশি ছিল, কেননা এখানকার উপজাতিয়রা ছিল চাষাভুষা, খেটে খাওয়া মানুষ; অধিকাংশই অক্ষরজ্ঞানহীন। অবশ্য খ্রিষ্টান মিশনারীদের মাধ্যমে এরা ধর্মকর্ম ও শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে আসছিলো বহুদিন যাবৎ। খুব সম্ভবত দেশ স্বাধিন হবার পর এদের-কে রাস্ট্রিয় কাঠামোতে বাঙলাভাষায় শিক্ষাদীক্ষা দেবার সুযোগ দেয়া হয়। তারই প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের উপজাতিয়রা এখন বেশ আলোকিত। এই সময় উপজাতিরা আধুনিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করছেন। জোসেফের পরিবারটিও তাই, চাষাভুষা দলের কিন্তু মিশনারী শিক্ষার প্রভাবে সে এবং তার ভাই-বোনদের অক্ষরজ্ঞানহীন থাকতে হয়নি।
জোসেফ সাংমার লেখক হয়ে ওঠাটা খুব বেশি গুরুত্বের বিষয় নয়। স্থানিয় যেসব ম্যাগাজিন, স্মরণিকা ছিল ওসবেই ছিল তার লেখার পরিধি। সে আসলে উপজাতিয়দের বিষয়ে তার বিভিন্ন ভাবনা প্রকাশ করে যাচ্ছিলো কিন্তু বিষয়টি উপজাতিয়দের মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্যই হয়ে ওঠেনি। একবার তার বন্ধুদের উৎসাহে স্থানিয় একটি উৎসবে গান লিখে দিতে হয়। সেদিন থেকেই মূলত তার লেখক পরিচিতিটা বাড়তে থাকে। তার বেশ মনে পড়ে গানটি শোনার পর খ্রিষ্টান মিশনের ম্যানেজার রথীন নকরেক তার পিঠ চাপড়িয়ে ধরেছিলেন। তারপর এই ম্যানেজারের চেষ্টায় মিশনারী কালচারাল একাডেমি থেকে তার লেখা গান নিয়ে একটি ক্যাসেট বেরোয়। ‘হাই খাম্বাইসাং রেনেকা’ চলো উত্তের যাই। এভাবেই ধীরে ধীরে সাহিত্যে তার পূর্ণ প্রবেশ।
বেশ কদিন যাবৎ গ্রেগর সামসার বিষয়টি মাথার মধ্যে ক্রিয়েট করার ফলে সে হতাশ হচ্ছিলো এই ভেবে যে, বোধ হয় ইদানিং পাগলামি বেশি করছে সে কিন্তু আজ নিজেকে কেন জানি তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে এবং বেশ ভালো মনে চা-নাস্তা সেরে লেখার টেবিলের দিকে যায়। আজ সে একটি গল্প লিখবে প্রথম। যে বিষয়টি গল্পাকারে লিখতে গিয়ে সে আজকের লেখক অথচ সেই গল্পটি আজো তার লেখা হয়ে উঠলো না।
টেবিলের উপর কাগজ সবই ঠিকঠাক কেবল উডপেন্সিলটা কাটা হয়নি। এই এক উৎপাত, এইসব টুকিটাকি কাজ সাধারণত কনসান্টেশান ব্রেক করে। জোসেফের মন খারাপ হয় আবার সে পিন্সলটা ছাড়া লিখতে স্বাচ্ছন্দও বোধ করে না। এই পেন্সিল ছাড়া লিখতে না পারাটাও আশ্চর্য লাগে! একসময় মানুষ নলখাগড়ায় কালি ভরে বিভিন্ন গাছের পাতায় লিখতো। আজকের মানুষের কাছে বিষয়টি আশ্চর্যের- কেননা তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন অত্যাধুনিক কলম ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছে।
ভবিষ্যতের মানুষের কাছে এই বলপেন ব্যবহার তথা হাতে লেখাটাও আশ্চর্যের মনে হতে পারে কেননা তখনকার মানুষেরা লেখার সমস্ত কাজ করবে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, রাউডারে। এ ব্যাপারে সে একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প পড়েছিল মনে পড়ছে তার ‘গল্পকার অমিত কহ্লার যেভাবে মিথ কহ্লার হয়ে যান’ গল্পটি মুজিব মেহদী’র লেখা ‘নিসর্গ’ নামে একটি ছোটকাগজে ছাপা হয়েছিল। পরে তার গল্প বইয়েও মুদ্রিত হয়েছে। বিষয়টি তারও পুরোপুরি বিশ্বাস হয় কিন্তু কিন্তু সে নিজে উডপেন্সিল ছাড়া লিখবে না এটাই তার স্বাভাবিক ইচ্ছা। ইরেজারে পেন্সিলটা কাটতে কাটতে হঠাৎ মনে পড়লো তার সেই পুরনো গল্পটি বোধ হয় লেখার প্রয়োজনিয়তা আর নেই। কেননা উপজাতিয়রা আজ শিক্ষাদীক্ষায় সর্বাগ্রে অবস্থান করছেন ফলে একদিন এরা নিজেদের প্রয়োজনেই ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্প সাহিত্য খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনবেন।
এ অঞ্চলে উপজাতিয়দের মধ্যে যরেথষ্ট ধর্মসাম্প্রদায়িকতা থাকা সত্ত্বেও প্রকটভাবে পালিত হতো না এই জন্যে যে, এ অঞ্চলে হিন্দু বা মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনের তুলনায় উপজাতি ছিলো হাতে গোনা কিছু পরিবারমাত্র ফলে মুসলিম ও হিন্দুদের অত্যাচারে ওদের নিরবে সহ্য করতে হতো। সম্পত্তিগ্রাসের চেয়েও যে অত্যাচারটি বেশি প্রকটভাবে দেখা গিয়েছিল সেটি হচ্ছে নারী নির্যাতন। এইসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কারুরই প্রতিবাদ করা সম্ভব ছিল না তখন কেননা তাতে অস্তিত্ত বিলোপের সম্ভাবনাই বেশি ছিলো। তাছাড়া সীমান্তএলাকা রক্ষার নামে যারা প্রশাশনিক ক্ষমতা নিয়ে যেতেন তারাও একইভাবে ভোগিদের দলে অন্তভুক্ত হতেন। উপজাতিয়দের এই স্বাধিনতা হরণের বিষয়টির বিপক্ষে অত্যন্ত প্রকট আকারে একটি গোত্র সংগঠিত হতে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে যার আগুন শেষপর্যন্ত গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তো।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় শেষমেষ বিষয়টি ডিশমিশ হয়ে যায়। সেদিনের সেই উত্তেজনা, সেই প্রতিবাদি সত্তাটিই আজকের লেখক জোসেফ সাংমা। কিন্তু দীর্ঘদিনেও জোসেফের গল্পটি লেখা হয়ে ওঠেনি কেননা সেদিনের সেই উপজাতিকুল আজকের যে সমাজে অবস্থান করছেন তাতে কারো কারো পারিবারিক ব্যক্তিত্বে আঘাত পড়াই স্বাভাবিক কেননা যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য পাহাড়ের কাটালতা ভেঙে আলোর প্রবেশক-কে দেখেছিল হয়ত তারই ফাঁকে ফাঁকে পঙ্কিলতাও প্রবেশ করেছিল।

Friday, July 3, 2009

লেউসা

পাহাড়ি শাক-লতা আর গজারির ডালগুলো আঁটি করে বোঝাটি কেবল কাঁধে নিয়েছে সে, অমনি চোখে পড়লো বনমোরগটি। উফ! একেবারে তেলতেলে। তীব্র শীতলতা আর ইন্ডিয়ান ঝর্ণার বৃষ্টিপতনের মতো ঝিঁঝিঁ শব্দের প্রতিবেশে সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। লেউসার পরনে নতুন লুঙ্গি, নতুন জামা পরায় লেউসার মনটা একটু আনন্দেই আছে। অল্পক্ষণের জন্য চিন্তা করে নিলো সে। কিন্তু এক হলো সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে আর হলো জাঙ্গিটাও সাথে আনেনি। কাজেই বনমোরগ শিকারের চঞ্চলতা আজ নিবৃত্তি দিবে কিনা ভাবলো একবার। মনে ভাবলো আবার, না থাক; আজকে না হয় চলেই যাই। কিন্তু দুষ্টুমিটা চাপলো তখনই যখন দেখলো, ময়মনসিংহে জন্মনেয়া ইন্ডিয়ান সেই বিএসএফটিই মোরগটিকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর সাথে সাথে একটি ঢিল ছুঁড়ে মোরগটিকে লাপাত্তা করে দিলো। কিন্তু উল্টোদিকে ঘুরে এসে বিএসএফটি তাকে ধরে ফেলতে পারে এটা তার একবারও মনে হলো না। বিএসএফটি দেখে ফেলার পরই কাঁধের বোঝাটি ফেলে দিয়ে পাহাড়ি লতামোড়ার জঙ্গলি পথেই দৌড়ে পালাতে চাইলো। বিদিশামতো দৌড়িয়ে তার ধারণার মতো একটা নিরাপদ জায়গা পেয়ে গেলো বটে কিন্তু জঙলার অন্ধকার আর অস্থিরতায় বাড়ি ফিরবার মূল রাস্তাটি সে হারিয়ে ফেললো। যাক, এরমধ্যে সে খুব গোপনে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়ার জায়গা বয়ড়াতলাটি পেয়ে গেলো, অধিক ডালপালাবিহীন প্রায় মরে যাওয়া বয়ড়া গাছটি নজরে এলো তার। তড়িঘড়ি ভেবে ধিরে ধিরে গাছে উঠে গেলো সে। উঠে ডালে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। বিএসএফটির অস্তিত্ব আর কোথাও দেখতে পেলো না। ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। লোকটা বোধহয় ভালো আছে কিন্তু বিএসএফ তো তাই ভয় লাগে। সাজু আর দীপকের সঙ্গে আড্ডা দেয় মাঝে মাঝে আবার তড়িঘড়ি করে চলেও যায়। সাজু বলেছিলো, চলে যাবার সময় বিএসএফটির চোখ যেন কেমন ছলছল করতে থাকে জলে; চেংড়াপেংড়া ওদের বিষয়টি কোনভাবেই ঠাহরে আসে না। তার কষ্ট হয়; কেননা, লোকটি আর কোনদিন বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারবে না।
সাজু এসে ডাক দেয়, কি রে লেউসা, তুই এখনো গাছে উঠে আছিস কেনো? তোর খড়ির বোঝা কোথায়? বাড়ি যাবি না?
লেউসা বলে, যাবো, আস্তে কথা বল ময়মনসিংহের বিএসএফটি বোধহয় আশেপাশেই কোথাও আছে। শালা বেটা আজকেও একটি বনমোরগ তাড়িয়ে এদিকে এসেছে।
সাজু বলে, বিএসএফ তো চলে গেছে।
-কখন গেলো, লেউসা প্রশ্ন করে?
-সাজু জানায়, একটু আগেই; কয়েকটি চালতা নিয়ে চলে গেছে। আমিই পেড়ে দিয়ে এলাম।
লেউসা একটু সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যাক বাবা বেঁচে গেলাম।
খড়ির বোঝা আর পাহাড় থেকে নেমে আসা গরুগুলির সাথে বাড়ি ফিরবার পথে সাজু লেউসাকে জিজ্ঞেশ করে, তুই বিএসএফটিকে এতো ভয় করিস কেনো? ওর সাথে তো আমাদের খাতির আছে। গল্পগুজব করে, ময়মনসিংহের আত্মীয়স্বজনের কথা বলে কাঁদে।
-লোকটা মনে হয় ভালো আছে কিন্তু তবুও ভয় হয় শালা বিএসএফ তো, দেখলি না সেদিন আন্দ্রে চিসিম কে বিএসএফরা কিভাবে গুলি করে মেরে ফেললো। পাহাড়ে ওর মরা দেহটি কেমন যেনো বারুদপোড়া গন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
-ওরা তো বড় বড় সেগুনগাছ কেটে ফেলে, একরাতে যদি সুযোগমতো গাছ কাটতে পারে তাহলে এরকম ২০/৩০টির মতো গাছ কেটে নিয়ে আসতে পারে, সাজু বলে। ওরা তো চোর সেজন্যই ওদের গুলি করে।
লেউসা বুঝে ওরা চুরি করে পাহাড় থেকে কাঠ কেটে নিয়ে চোরাই বাজারেই বিক্রি করে দেয়। কিন্তু ওরা তো গরিব; ছেলে-বউ-সন্তানাদি নিয়ে বেঁচে থাকার অন্বেষায় চুরি করে কাঠ কাটাকেই জীবিকা হিসেবে নেয়। ওদের তো কিছু করার নেই। যারা চোরাই বাজার তৈরি করে এইসব কাঠ কিনে নেয় তাদেরই তো শাস্তি হওয়া উচিত। ভাবতে ভাবতে অর্চি মিরংয়ের কথা মনে পড়ে তার। অর্চির পরিবারও পাহাড়ে কাঠ কাটে। তবে ভারি কাঠ নয়। রান্নাবান্নার জন্য প্রয়োজনীয় যে কাঠ ব্যবহার হয় সেই কাঠ কাটে। অর্চিও পাহাড়ে কাঠ কাটে, মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ফিরে বিকেলবেলা পাহাড়ে কাঠ কাটতে যায়। অর্চিও তো একদিন এরকম গুলি খেয়ে মরে যেতে পারে। লেউসা অর্চিকে ভালোবাসে আর অর্চিও লেউসাকে ভালোবাসে -অর্চি বলে, তবে ওইরকম ভালোবাসে না, সে তার নিজের মধ্যেই আত্মমগ্ন থাকে বেশি। স্কুলে যখন অর্চি বন্ধুদের নিয়ে মগ্ন থাকে বেশি তখন লেউসার কষ্ট হয়। অর্চি যেদিন তার পকেট থেকে পাইলট কলমটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো জঙ্গলে... সেই রাগ থেকেই পলির হাতের এক থাপ্পর খেয়েছিলো আবার বাড়ি ফিরেও বাবার হাতে বেতের বাড়ি। তবু অর্চিকে সে ভালোবাসে কারণ তার ফুফাকে অর্চি একদিন প্রণাম করেছে। আর অর্চিই তাকে শিখিয়েছে ওদের ভাষায় নাঙ-আঙ মানে তুমি-আমি। আঙা নাঙ্খো নামিনিকা মানে আমি তোমাকে ভালোবাসি। পলির ওই ব্যবহারে আজও ওর শরীরে জ্বালা হয়, ব্যাপারটা সাজু জানে। ওই রাগ থেকেই সুসান রংদির সাথে লেউসা-সাজুদের ঝগড়ার সূত্রপাত। একদিন তো নই খেলার ছলে ঝিক দিয়ে সুসানের মাথাই ফাটিয়ে দিয়েছিলো। সেকি রক্তপাত!
-লেউসা সাজুকে জিজ্ঞেস করে, অর্চিকে আজ দেখেছিস রে?
-সাজু বলে, নাহ! আজকে মনে হয় অর্চি কাঠ কাটতে আসেনি। ইদানিং বিএসএফদের পাহাড়া খুব বেড়ে গেছে। মনে হয় সেজন্যই হোগলির মহিলারাদের কাঠকাটা কমে গেছে।
মুহূর্তেই মনে পড়ে লেউসার, আজকে ওদের গরুগুলির একটিও পাহাড় থেকে ফিরে আসেনি। সে সাজুকে বললো, সাজু? আজকে তো গরুগুলি একটিও ফিরে আসেনি রে। বিকেল থেকেই দেখেছিলাম একদম ঝিঝাঙের মাঝামাঝি ধারি তাজা ঘাসে খাবারে ব্যস্ত সব গরু। ইস! বিএসএফরা আবার ধরেও নিয়ে যেতে পারে রে। এরকম হলে বিডিআর-বিএসএফ হোয়াইট ফ্লাগ মিটিং ছাড়া গরু উদ্ধার কোনভাবেই সম্ভব নয়। সত্যিই হলো তাই, ওরা সুখেন ছড়ার কাছাকাছি যেতেই নেমতের সাথে দেখা সে বললো, আমাদের গরুগুলিকে বিএসএফদের ধরে নিয়ে যেতে দেখেছে সে। নেমতের কথা অবশ্য কেউ বিশ্বাস করে না। ওই শালা বেটা একদিন ওর গোয়ালের বাছুরের সঙ্গে সেক্স করেছে, বলে কিনা! ওই বাছুরটা তার বউ তাই সে ওর সাথে সহবাস করেছে। কিন্তু তবুও চেয়ারম্যান ওকে পাগল বলে জুতা দিয়ে পিটিয়েছে।
-লেউসা সাজুকে বলে চল তো, ঝিঝাঙের আশপাশটা ঘুরে দেখে আসি গরুগুলি এখনো ওখানে আছে কিনা। বিএসএফরা গরু যখন ধরে নিয়ে যায় তখন গেরস্থের বিপদ বাড়ে। মানুষে মানুষে থানা হাজতের যে ঝামেলা, গরুর জন্যে ক্যাম্প-বিডিআর মিলে গেরস্তের সেই বিড়ম্বনা হয়। কোন কোন সময় এমন হয় যে, গরুর জন্য গেরস্তের এক সিজনের ফসলই ঘরে উঠে না। এই যন্ত্রণা লেউসার ভালো লাগে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, প্রায়ান্ধকারেই ওরা ইন্ডিয়ান পাহাড় ঝিঝাঙের দিকে গেলো। কিন্তু ইন্ডিয়ান পাহাড়ের গভীর অরণ্য থেকে গরুগুলি কোনভাবেই উদ্ধার করতে পারলো না।

একদিন, দুইদিন, তিনদিন এভাবে এক সপ্তাহ চলে গেলো তবু ওদের গরুগুলি আর উদ্ধার করতে পারল না। বিডিআর হোয়াইট ফ্ল্যাগ মিটিঙের আহ্বান করলেও বিএসএফরা তাতে রাজি হলো না। লেউসাসহ ওদের পরিবারও একটি বিপত্তির মধ্যে পড়লো। এরমধ্যে ওদের এলাকায় একটি মজার কাণ্ড ঘটলো। উঁচু উঁচু ওই পাহাড়ি ঢালপথে ইন্ডিয়ান বিএসএফরা যেসব তেজি ঘোড়া নিয়ে চলাফেরা করে সেইসব ঘোড়াগুলির মধ্য থেকে MQN 146 তেজি একটি ঘোড়া সীমান্তরেখার এলাকা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। রাখাল সমিতির প্রেসিডেন্ট সিদ্দিক আহমদের সেকি উল্লাস! ভারত সরকারের ঘোড়া উদ্ধারের জন্য এবার আমাদের গরুগুলি নিশ্চয়ই বিএসএফরা ফিরিয়ে দেবে। বিডিআরদের হোয়াইট ফ্ল্যাগ মিটিং আহ্বানের পর এবার বিএসএফরাই মিটিং আহ্বান করলো। বাংলাদেশি বিডিআর তাতে সম্মতিও দিলো। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখা চিহ্নিত জায়গাটির কাছাকাছি ছোট একটি পাহাড়ে যেখানে ফ্ল্যাগ মিটিং হয় সেখানেই মিটিঙের সিদ্ধান্ত হলো। এরকম মিটিং হলে বাংলাদেশ থেকে বিডিআর সদস্যসহ এলাকার কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিও উপস্থিত থাকেন। লেউসার ফুফাও ওই মিটিঙের একজন হিসেবে থাকেন। কিন্তু এবার কি পরিস্থিতিতে এইসব গণ্যমান্যরা আশেপাশে থাকলেও সরাসরি মিটিঙে থাকতে পারবেন না। পরিস্থিতি খুবই গরম। এমনই গরম যে বিডিআর সদস্যদের পরিস্থিতি হলো স্টেপ টু ফায়ার। মিটিঙের আগের দিন থেকেই বিডিআর সদস্যদের আনাগোনা বেড়ে গেলো। ফ্ল্যাগ মিটিং পাহাড়ের আশেপাশে বাংলাদেশি পাহাড়গুলোয় মেশিনগান, বাঙ্কারগুলো সচল করা হলো। যথারীতি মিটিং বসলো। হোয়াইট ফ্ল্যাগ নিয়ে বিডিআর-বিএসএফ সদস্যদের আগমন দৃশ্যটি সবাই দেখলো দূরে দাঁড়িয়ে। ধিরে ধিরে মিটিঙে কথাবলা, তর্কাতর্কি, ইংরেজি-বাংলা-হিন্দি ভাষায় তৈরি হলো উত্তপ্ত একটি মুভমেন্ট। লেউসার খুব ভীতি হলো এবার বোধহয় নিশ্চিত বিডিআর-বিএসএফ যুদ্ধটা লেগেই যাবে। বিডিআর সদস্যদের আড্ডা থেকে ওদের কথাবার্তাও শুনেছে সে বিভিন্ন সময়। ওরা বিএসএফদের সাথে যুদ্ধ করতে চায়। সীমান্ত এলাকার এইসব অতন্দ্র প্রহরী প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে বিএসএফদের উপর। অবশ্য বিডিআর-বিএসএফ যুদ্ধের কি কারণ থাকতে পারে, লেউসা তার বিস্তৃত জানে না। সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তো ওদের গরুগুলি আর ফিরে পাবে না। হঠাৎ কী এক আচমকা শব্দে একটা বোমা ফাটলো। টিলার আশপাশটা ধোঁয়ার আচ্ছন্নতায় মিটিং ছেড়ে বিডিআর-বিএসএফ সদস্যরা বেশকিছু গুলির বিকট শব্দ করতে করতে দ্রুত ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। খুব দ্রুত হুড়োহুড়ি করে ওই এলাকার লোকজনও মিটিংপাহাড়ের আশপাশ থেকে সরে গেলো।

নানাবিধ যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে থাকলো লেউসা। এরমধ্যে অর্চিরও বিয়ে হয়ে যাবে। বর পছন্দ করতে সে পুটিমারি চলে গেলো। বর যদি পছন্দ হয় তাহলে ওখানে সপ্তাহখানেক থেকে বরসহ সে বাড়িতে চলে আসবে। খবরটা শোনার পর লেউসার মাথাটা খারাপ হতে থাকলো। অবশ্য কানাঘুষাটি সে আগেই শুনেছিলো, অর্চিও বলেছে একদিন; খুব শিগগির তাকে বিয়ে করতে হবে। বন্ধুবাৎসল্ল্যবিহীন এই পৃথিবীটা মানুষের থেকে ক্রমশ ধূসর-বিমুখ। লেউসার একাকিত্ব ক্রমাগত তাকেই পীড়িত করলো। ওদের বাড়ি থেকে পুটিমারি অনেক দূরের পথ। লেউসার মনে হলো, এখনি তার পুটিমারি যাওয়া উচিত। গিয়ে অর্চিকে জিজ্ঞেশ করা উচিত বিয়ে করবে যদি তাহলে আমাকে ভালোবেসেছিলে কেনো? মন খারাপ আর অস্থিরতায় সে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। মনে ভাবলো, মেয়ে মানুষ বোধহয় প্রতারক চরিত্রনিয়তিতেই প্রবৃত্ত হয় লেউসার মতোদের জন্যে।
সপ্তাহখানেক পর অর্চি বর নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। সবাই বর দেখলো। সুদর্শন। ডেভিড ওয়াশিংটন লোকটা ভালো আছে। সবাই বললো, অর্চির সঙ্গে মানিয়েছেও ভালো। খুব ভালো বেডমিন্টন খেলায়। কিন্তু লোকটাকে দেখার পর লেউসার খুব রাগ হলো। কোথায় অর্চির পাশে থাকবে সে তা না ওয়াশিংটন! লেউসার মনটা সত্যি খারাপ হয়ে গেলো। টপটেন সিগারেটের প্যাকেট আর বাঁশিটা কোমরে গুঁজে; জুয়েল ফ্লাওয়ার রেডিওটা হাতে নিয়ে পাহাড়ের দিকে যেতে শুরু করলো, সাজুকে খুঁজে বের করে আজকে ‘সহধর্মিনী’ ছবির কাহিনীটা শোনাবে সে। মা শবনম, বাবা রাজ্জাক আর ছেলে, নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের দুর্দান্ত অভিনয়ের ছবি।

দীর্ঘদিন পর লেউসার মন আবারো খারাপ হলো। চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো আর রেডিওতে বিবিসির খবর শুনছিলো সবাই। পিথিশ হাজং এসে পরিবেশটাই বিগড়ে দিলো। অহিত মোড়ল পিথিশকে নিজহাতে চা বানিয়ে খেতে বললেই সে এই কাজটা করে। চা বানানোর আগে দুধের পট থেকে কিছুটা দুধ আগে হাতে ঢেলে খেয়ে নেয়। এ জন্যই অহিত মোড়ল পিথিশকে একটা কড়া গালি দিলো।
-জাউরা হাজং! দেশে গজব পড়ছে আর তুই কিনা দুধ খাওয়ায় অন্ধ হয়ে গেলি।
-পিথিশ জিজ্ঞেশ করে, কি হয়েছে মোড়ল?
-দেখছিস না সবাই বিবিসির খবর শুনছি, সান্দাখালির অজয়নাথের ছেলেবউকে গতরাতে বিএসএফরা র‌্যাপ করেছে। পাঁচ-ছয়জন ছিলো। যাবার সময় অজয়নাথ আর তার ছেলেসহ এলাকাবাসী ওদের আটকে ফেলেছে। তিনজন একেবারে মার্ডার, দুজন আহতাবস্থায় পালিয়েছে। একজনকে অজয়নাথের ছেলে কাঠকাটার দা দিয়ে পায়ের টোতে কোপ মেরে একেবারে দুভাগ করে বিডিআর সদস্যদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। সান্দাখালি বিডিআর ক্যাম্পসহ এলাকাটা বিডিআর-পুলিশের আনাগোনা আর যুদ্ধের ভয়ে থমথম হয়ে আছে। এবার শুধুমাত্র বিডিআর-বিএসএফই নয়, স্বাধিনতার জন্য বাংলাদেশের যে যুদ্ধ করতে হয়েছিলো পাকিস্তানের সংগে সেই যুদ্ধই এখন লেগে যাবে ভারতের সংগে।
-পিথিশ বলে, ই জিনিশটাই আমার ভালো লাগে না মোড়ল। বিডিআর বিএসএফ মিলে ঝগড়া তাই আমরা কি করেছি। আমাদের উপর শুধু গজব পড়বে, ই জিনিশটাই আমার ভালো লাগে না। বলতে বলতে সে নিজের চা নিজেই বানিয়ে খেলো।
সীমান্ত এলাকায় এই ঘটনা প্রায় নিতিদিনের। লেউসা ভাবলো একবার সান্দাখালি যাবে আজ। থমথমে পরিবেশটা দেখে আসবে। কিন্তু বাড়িতে নিজের কাজের ঝামেলা আর লোকজনের ভয়ভীতিতে তার যাওয়া হলো না। গেলো না সে গোলাগুলির ফাঁকে পড়ে মরার ভয়েও। কে জানে যুদ্ধের তো কোন ঠিক-ঠিকানা নেই।

সুদিপ মিরং দীর্ঘদিন পর বাড়ি এসেছে। আর্মিম্যান। যশোরে পোস্টিং। ওদের বাড়ির সবাই মোটামুটি আনন্দে আছে। অর্চির ভাবি লেউসাকে খবর পাঠালো আজকে ওদের বাড়িতে একবার যেতে। লেউসার প্রিয় পাকা চাউলা কাঠাল খেতে। অর্চিদের বাড়িতে যেতে লেউসার আর ভালো লাগে না। অর্চির বিয়ের পর থেকেই ওদের দিকে লেউসার মনটা মরে গেছে। তবু মাঝে মাঝে যায়। অর্চির ভাবির সাথে মজাটজা করে আসে। এরমধ্যে অর্চি সন্তান সম্ভবা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত সন্তানের মা হবে। আবার এরমধ্যে সন্তানের মা হয়েও গেলো কিনা উদাসিনতায় লেউসার আর প্রবৃত্তি বাড়ে না। অর্চিদের বাড়িটাই যেন দিনে দিনে ওর কাছে অনাত্মীয়ের হয়ে গেছে। অথচ এই বাড়িটাকেই তার নিজের বাড়ি মনে হতো। ওদের বাড়ির পেয়ারা গাছ, জাম্বুরা, আনারস আর কাঁঠালের গাছগুলি যেন এখন স্মৃতি ভারাতুর। স্মৃতি ভারাতুর হয়ে আছে স্কুলে প্রায় প্রতিদিনই অর্চির জন্যে তার অপেক্ষা করা।
সান্দাখালি যাওয়া হয়নি তাই মনে ভাবে ঠিক আছে অর্চিদের বাড়িতেই যাই একবার। সুদিপদা-ভাবির সংগে গল্পগুজব করে আসি কিছুক্ষণ। অর্চি ছেলের মা হয়েছে। বাড়িতে আনন্দের ছড়াছড়ি। আত্মীয়তে বাড়িটা গমগম করছে। লেউসা সুদীপ মিরং, তার বউ আর ওদের বান্ধবী মৃদুলা দারিঙের সঙ্গে আড্ডায় মগ্ন হয়ে গেলো। প্রথমেই তার অর্চিকে দেখতে যাওয়া উচিত ছিলো কিন্তু সে যায়নি। মনে জেদ হয়েছে, তার এই না যাওয়াটাও যেন এক ধরনের প্রেমের প্রতিযোগিতা। খানিক পর অর্চি তার ছেলেকে কোলে নিয়ে সামনে এলো। লেউসা দেখলো অর্চির শরীরটা শাদামতো ফ্যাকাসে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। স্বতোস্ফূর্ত অর্চি তার নবজাতক শিশুটিকে লেউসার কোলে দিলো। ভীষণ ফুটফুটে শিশু! একেবারে স্বর্গীয় শিশুদের মতো। যে রকম শিশু দেখলে খুব আদর করতে ইচ্ছে করে।
-লেউসা অর্চিকে জিজ্ঞেশ করলো, জামাই বাবুকে কোথাও দেখছি না যে।
-অর্চি বললো, ও পুটিমারিতে, বাড়িতে জরুরি একটা কাজে গেছে। আজকেই চলে আসবে।
শিশুটিকে কোলে নিয়ে লেউসার মনটাও কি যেন আনন্দে শিশুর মতো হয়ে গেলো। তার মনে চঞ্চলতা খেলা করলো। হঠাৎ কি যেন শিশুটির সঙ্গে কথায় মগ্ন হবার প্রবৃত্তি হলো তার। আদরের ফাঁকে শিশুটিকে তুলতুলে প্রশ্ন করলো, কি রে বেটা? ওয়াশিংটনের জারজ। ভালো আছিস?
মুহূর্তেই মনে হলো, এটা সে কি বলেছে! তার সঞ্চারণে আচমকা একটা ধাক্কায় সে অর্চির দিকে তাকালো। অর্চি টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্চির ভাবি বিছানা থেকে উঠে শোকেস থেকে একটা গ্লাস আর সুই নিলো। তারপর সোফায় লেউসার মুখোমুখি বসে থাকা অর্চির বুকের শাড়ি ফেলে ব্লাউজের বোতামগুলো খুলে ফেললো। লেউসা দেখছে অর্চির ভরাট খোলা দুধে ধরে ওর ভাবি সুই দিয়ে স্তনের বোটা ফুটো করে তার বুক থেকে টিপে টিপে দুধ বের করে আনছে। শালদুধ। লেউসা অবাক হয়ে দেখছে ঘটনাটা। সে একেবারে থ হয়ে গেলো যখন সেই দুধ সন্তানকে খেতে না দিয়ে অর্চি নিজেই খেয়ে ফেললো। ঘটনাটি অবশ্য তার কিছুতেই বোঝার নয়। তার মনে হলো হায় হায় অর্চি এটা কি করলো, সে নিজেই নিজের বিষ খেলো না তো! নিজের দুধ নিজের খেতে হয় বিষয়টি লেউসার জানা নেই। তার মনে পড়লো নিজেরই যন্ত্রণায় একবার সে বিষের বোতল নিয়ে পাহাড়ে উঠে গিয়েছিলো আত্মহত্যা করবে বলে। কথাটি সে অর্চিকে বলেছিল একদিন। অর্চি কি তাহলে সন্তান জন্মের পর নিজের দুধ খেয়েই নিজের মধ্যে আত্মহত্যা করলো? বিষয়টি বুঝতে পারে না লেউসা। মাথা নিচু করে নিরবে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। বিদ্যুতশকের মতো বৃহৎ একটা ঝাকি খেলে সে। ছেলেকে অর্চির কোলে ফিরিয়ে দিয়ে নিরবে ওদের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। নিজের মধ্যে সে অস্থিরতা অনুভব করলো। এমন আর লাগেনি কখনো।
বাড়ি ফিরবার পথে দীপকদের বাড়িতে ধারিকা কাকির বিকট চিৎকারে কান্নার গলা শোনে থমকে দাঁড়ায়। আজ কি হলো ধারিকা কাকির? কেউ মরে গেলো না তো! বিদেশ কাকার বয়স হয়েছে অনেক সেই কি মরে গেলো কিনা! নাকি ওদের কাউকে সাপে কামড়েছে অথবা বাঘে খেয়েছে! বিষয়টি দেখার জন্য সে দীপকদের বাড়ির দিকে যায়। বিডিআর আর লোকজনেভর্তি বাড়িটা। লেউসার বুকটা ধক করে কেঁপে উঠলো ধারিকা কাকির আহাজারির দৃশ্য দেখে।
-কি হয়েছে? সে জিজ্ঞেশ করলো।
লোকজন বলাবলি করছে, লাশটা বোধহয় আর ফিরে পাওয়া যাবে না। লেউসা বুঝতে পারে না কার লাশ? কোথায় পড়ে আছে?
-সে আবার একজনকে জিজ্ঞেশ করে কি হয়েছে? কিসের লাশ?
একজন জবাব দেয় বিদেশ বাবুর ছেলে দীপককে বিএসএফরা গুলি করে মেরে ফেলেছে।
-বলেন কি, কেনো? বিএসএফরা কেনো দীপককে গুলি করলো? ওর তো অনেক বিএসএফের সাথে খাতির ছিলো।
দীপক অস্ত্রপাচার করতে গিয়ে বিএসএফদের হাতে গুলি খেয়েছে।
দীপক অস্ত্রপাচারের সংগে জড়িত ছিলো বিষয়টি লেউসা তার নিজের মধ্যে বিশ্বাস করতে পারে না। তার শুধু মনে পড়লো কত বিএসএফ-বিডিআর ওদের বাড়িতে নিরবে বসে মদ খেয়েছে, খাতির করেছে। বিএসএফদের কি কোন ধর্মই নেই? ওরা দীপককে গুলি করলো! নিজের অস্থিরতাকে সে আর দমিয়ে রাখতে পারছে না। মাথাটা পাহাড়ের মতো ঝিম মেরে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলো প্রায়।
আনমনেই লেউসা বাড়ি না ফিরে সোজা পাহাড়ের দিকে গেলো। কিছুই ভালো লাগছে না তার। পাহাড়ের শীতল মাটিতে স্তব্ধ হেলান দিয়ে ভাবছে সে, মাহিন সাংমার দেখা পেলে ইন্ডিয়ান লতা দিয়ে পেচানো বাঁশিতে বানিয়ে সাধুর দরগায় বসে আজ গাঁজা খাবে। সাধুর কথা মনে পড়লো তার, গাঁজা খেয়ে মানুষ আত্মদমন আর পীড়ন থেকে নিবৃত্তি নেয় আল্লাকে একান্তভাবে সাধনায় পাবার জন্য। নিজের ভেতরের আয়নায় নিজেকেই পরিষ্কার দেখা যায়। কিন্তু বয়ড়াতলায় গিয়ে লেউসা যা দেখলো তা তাজ্জব-অবাক হওয়ার মতোই বিষয়। ফিসফাস আর মৃদু গোঙানিতে অপ্রকৃতিস্থ সাজু আর ময়মনসিংহে জন্মনেয়া সেই ইন্ডিয়ান বিএসএফটিকে দেখতে পেলো লেউসা। অদূরে, ঝিঝাঙের ঝাপসা ঢালুপথেই সে দেখলো
MQN 146 ঘোড়াটি, পাহাড়ে মেঘের রেখা ধরে ধরে ঘাস খাচ্ছে। আজ এই দিনে লেউসার কি হলো সে নিজেই ভেবে পেলো না। মুহূর্তেই মাথাটা ধরে আসলো। সবকিছুই অসার, অপ্রকৃতি আর তার মিথ্যে ধারণার মনে হলো। সে বসে পড়লো মাটিতে। চোখের অপ্রকৃতিস্থ গতিময়তা টের পেলো। লতাপাতায় মোড়ানো পাশের একটি গর্ত থেকে বিষাক্ত একটি সাপ বেরিয়ে এলো, ধিরে ধিরে জঙ্গলের দিকে হারিয়ে গেলো। শরীর ঘেমে আসলো লেউসার। সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।

৩০ জুন - ৩ জুলাই ২০০৯, দৈনিক শেয়ার বিজ্ কড়চা, সেগুন বাগিচা, ঢাকা।

বিরল কাহনের কল্পগল্প ও তার খসড়া

প্রণম্য পাঠক, একটু সচেতন হলে বোঝা যাবে যে ইনি নিতান্তই একটি শাদামাটা গল্প তৈরির কল্পনায় ফাঁদ পাতার চেষ্টা প্রায়শই করে থাকেন। তার এ প্রবণতার কারণ তিনি একজন সফল গল্পকার হয়ে ওঠেন না নিজের কাছেই। জনান্তিকে তিনি এ কথাও বলে বেড়ান যে, একটি ভালো গল্প লেখার কল্পনাচেষ্টায় বেশ কিছুদিন রত আছেন তিনি। তার সম্পর্কে আরেকটু স্পষ্ট ধারণা দিতে, প্রণম্য পাঠক অগ্রেই বলে রাখি, তিনি একজন সফল গল্পকার না হলেও সম্প্রতি তার একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পাণিনির অষ্ঠাধ্যায়ী। সুধিমহলে এরকম শোনা যায় যে কাব্যটির শিল্পমাণ নেহায়েত মন্দ নয়। গল্পকার বিরল কাহন অবশ্য এর ভিন্ন মন্তব্য করে থাকেন ‘একটি ভালো গল্প তৈরির প্লট মাথায় নিয়ে কল্পনা করেও যখন শেষমেশ গল্পটি লেখা হয়ে ওঠেনি, তখন ভীষণ মনোকষ্ট নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি সপ্তাহের পর সপ্তাহ। দিনলিপি লেখার মৃদৃ অভ্যাস আমার ছিল। ওই ব্যর্থতার সময়েই আবেগভরে নিয়মিত দিনলিপি লিখা হতো।
আমার গল্পের প্রাথমিক থিম শ্রোতার মধ্যে যারা আছেন তারা অর্থাৎ আমার বন্ধু, অফিসের কলিগ ও প্রাক্তন ম্যাসের কয়েকজন প্রাইভেট টিউটর প্রায়ই বলে থাকেন যে, আমার গল্পের থিমের চেয়ে দিনলিপিগুলোর বিশ্লেষণ তাদের কাছে অনেক সুখপাঠ্য কাব্য। শেষমেশ যেহেতু আমার কোনো গল্প লেখা আজো হয়ে ওঠেনি তাই অগত্যা দিনলিপিগুলোই কাব্য বলে এক প্রকাশক বরাবর জমা দিয়েছিলাম। এগুলো যথার্থ কাব্য বলে মনে হলেও সে বিষয়ে আমার বিশেষ কোনো কৌতূহল বা অতিব্যঞ্জনা নেই। আমার একান্ত লক্ষ হচ্ছে গল্পলেখা। আমার বান্ধবী নজিতা, সে অবশ্য আমার গল্পলেখার ব্যাপারে খুবই হতাশ। দীর্ঘদিন লিখবো লিখবো করেও লেখা হচ্ছিলো না বলে। আমার এক কলিগের বন্ধুপত্নী সে। বন্ধুসূত্রে তার বাসায় হঠাৎ হঠাত সান্ধ্যআড্ডায় উপস্থিত হতাম আমরা। স্বামীর চেয়ে একটু বেশি চঞ্চল স্বভাবের, সেটা অবশ্যই অতি কথনের পর্যায়ে পড়ে না। ওর প্রতি আমার স্বাভাবিক দুর্বলতা কিংবা সহানুভূতির কারণ হচ্ছে, মৃদু উষ্ণ একটি শহরের শিক্ষিতা মেয়ে সে। অধিকাংশ সময়েই বিষাদাক্রান্ত। একটি কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষিকা। দুবছরের একটি মেয়ে আছে তার। নাম চর্যা। তার এই বিষাদাক্রান্ততা বা আত্মমগ্নতার কোনো সুস্পষ্ট কারণ আবিস্কৃত হয়নি এখনো। অবশ্য সে ব্যাপারে উদ্বিগ্নও নই আমি বরং উদ্বিগ্ন আমার গল্পলেখা বিষয়ে তার হতাশার কথা জেনে। আদৌ কী আমার কোনোদিন একটি গল্প লেখা হয়ে ওঠবে? বৃথাই কী চেষ্টাআত্তি করে যাচ্ছি আমি।’
সহৃদয় পাঠক, গল্পকার বিরল কাহন শেষমেশ কোনো গল্প লিখবেন কী লিখবেন না সে বিষয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই কিন্তু স্বাভাবিক কৌতূহল হচ্ছে যেসব গল্প লিখবেন বলে তিনি কল্পআখ্যান তৈরি করেন। সেগুলো থেকেও একটি চমতকার গল্পের পাণ্ডুলিপি দাঁড় করাতে পারেন তিনি। কিন্তু এখনো তার লিখতে না পারার কারণ একটি প্রশ্নবোধকের মধ্যে দোদুল্যমান। সম্প্রতি তিনি বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রির নাম সূচিতা, একজন ওয়েব প্রোগ্রামার। অবশ্য তাকে পুরোপুরি প্রোগ্রামার বলাও ঠিক হবে না কারণ সদ্য তিনি ইটার্নি শেষ করেছেন। বর্তমানে আইটি ফিল্ডের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। কোথাও কাজ করছেন না। স্বামী সম্পর্কে ভীষণ কৌতূহলী তিনিও। ‘আমার স্বামী কাজী লুতফর রহমান বিরল। ফিলোসফিতে অনার্স-মাস্টার্স। উচ্চতা ৫ ফুট ৯। ফর্সা। সুদর্শন। একেবারে প্রথম চোখে পড়ার মতো। তার সাথে পরিচয় আমার বড়বোন নজিতার বাসায়। প্রথম থেকেই ওর ব্যক্তিত্ব মনে লাগার মতো। নজিতাই দুজনকে বিয়ের অফার করেছিলো। আমাদের কারোরই অমতের কারণ ছিল না। নজিতার খুব ভালো বন্ধুসূত্রে তার সম্পর্কে আমারও ভালো ধারণা ছিল। শেষমেশ বিয়েটা হয়ে গেল। আপনাদের গল্পকার বিরল কাহন বিষয়ে আমার খুব বেশি কৌতূহল ছিল না কিন্তু বিয়ের পর থেকে তার এই সত্তাটি বিষয়ে প্রবল আকর্ষণ অনুভব করি। তার গল্পের প্রবল কল্পাখ্যান শুনে হঠাত আবিষ্কার করি তিনি কল্পনা থেকে খুব মজার মজার গল্প শোনাতেন বটে কিন্তু লিখতে পারছেন না। নিছক গল্পের একজন ভালো সমঝদার বা পাঠক ছিলাম না বলেই তার না লেখার কারণ আমারও অনাবিষ্কৃত।’
মানুষের উপলব্ধিশক্তি খুব বেশি প্রবল নয় বলে হয়তবা একেঅপরের অন্তর্গত সত্তাটিকে কোনদিন চেনা-জানা হয়ে ওঠে না। মহাবিপদ! ইনি গল্প না লিখলেও সৌরসাহিত্যে কম হবে বলে ধারণা পোষণ করি না। কিন্তু ইনি যদি গল্প নাই লিখবেন তবে নিজেকে গল্পকার বলে বেড়াবেন কেন? আমাদের কৌতূহল আরো বেড়ে ওঠতে থাকে। ফলে এখন তিনি আমাদের নিরীক্ষাসীমার মধ্যে অবস্থান করছেন। খুব তথ্য-তালাশ করে তার একজন বন্ধু পাওয়া গেল ইউনিভার্সিটিতে থাকা সময়ের। নাম সরোজ আহসান। কিন্তু আমাদের খুব বেশি তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন না। ‘কিডনী রোগে আক্রান্ত হলে আমার একবার ভারতে যেতে হয় চিকিতসার জন্যে। ভার্সিটি জীবনের প্রথম। নতুন এসেছি। জানাশোনা কম। প্রচুর টাকা প্রয়োজন। চারদিকে তাকালে বাঙালির কী করুণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি। প্রতিটি মানুষ আপন আপন কাজে ব্যস্ত! একা! ডানে-বামে কারো তাকাবার সুযোগ হয় না। কেউ কারো নয়! মনে হচ্ছিলো বিশাল অংকের টাকা পরিবারের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। সুতরাং চিকিতসাও সম্ভব নয়, মৃত্যুই আমার চূড়ান্ত নিয়তি। করুণ হতাশায় মনটা ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছিলো। হঠাত এই ঘোর অমানিশায় বিরলের সংগে পরিচয়। ভদ্রোচিত চেহারা। ফর্সা। লম্বা। মাথায় সামান্য টাক। প্রকৃতির প্রতি ভরসার আশ্বাস দেন। বিরলই শেষমেশ দিনের পর দিন আমাকে নিয়ে সকল ছাত্রাবাস, বিভিন্ন মহল ঘুরে ঘুরে চিকিৎসার লাখ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ভারতে নিয়ে যায়। মূলত বিরলের চেষ্টার জন্যেই আমার আজো বেঁচে থাকতে পারা। এরপর থেকে ভার্সিটিতে বিরলই আমার একমাত্র কাছের বন্ধু। বিচিত্র জাতের গাছের শুকনো পাতা সংগ্রহ করা তার একধরনের অভ্যাস। সে যেসব জায়গায় বিচরণ করেছে সেখান থেকেই কোনো না কোনো শুকনো পাতা সংগ্রহ করে এনেছে। এরকম কাজের কী ব্যাখ্যা আছে আমার জানা নেই। হঠাত কাউকে না বলে রুম থেকে একমাস/দুমাস নিরুদ্দেশ, কোথাও চলে যাওয়া। আবার মাস-দুয়েক পর কাপড়-চোপড়, চুল-দাড়ি, নখ, রুগ্ন ও নোংরা হয়ে পুনরায় ফিরে আসা। এরকম বহুবার করেছে। জিজ্ঞেশ করলে উত্তর দিতো ‘ভালো লাগছিলো না কিছুই তাই হেঁটে হেঁটে উত্তরবঙ্গ ঘুরে এলাম। প্রতিবারই কোন না কোন নতুন জায়গা। একটি বিষয় বলে রাখি বিভিন্নস্থানের পুরনো রাজবাড়ি, স্থাপনা, পতিতালয়, দ্বীপাঞ্চল, বনাঞ্চল দর্শন ইত্যাদি ছিল তার প্রধান কৌতূহলের বিষয়। তার নোটবুক পড়লে পাওয়া যেত বিভিন্ন গাছের কথা, পাতার কথা, রাজবাড়ি-স্থাপনার বিবরণ, রাজা-রাণী, খোজা, রাজার উপপত্নী, গণিকা এদের বিচিত্র তথ্য ও সংস্কৃতির পরিচয়। দিনলিপি সংগ্রহ তার অনিয়মিত অভ্যাস। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে খাতার একেক পৃষ্ঠার মধ্যে পেন্সিল দিয়ে ছবি এঁকে রাখাই ছিল তার কাছে দিনলিপি। কল্পনা থেকে গল্প তৈরি ও বলা তার একটি অভ্যাস। মজার মজার কল্পগল্প শোনে চাঁদনীতে কেটে যেত রাতের পর রাত। আমার জীবন নিয়ে বিশেষ করে অসুস্থতা নিয়ে খুব সুন্দর একটি কল্পগল্প সে তৈরি করবে বলেছিল। আজঅব্দি তৈরি হলো কিনা জানা হলো না।’
গল্পকার বিরল কাহন জনপ্রিয় কোনো সুলেখক না হলেও ইতোমধ্যে তিনি আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তার বিচিত্র প্রকাশে। পাঠককুল, আপনারাও হয়ত নিজের মতো করে তাকে আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এদিকে তার না লেখার কারণ বিষয়ে আমাদের আবেগ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। ফলে একদিন কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিই তার না লেখার কারণ আমরা আবিষ্কার করবোই। রাত দশটা কী এগারোটা আমরা রওনা হই তার বাসার দিকে। আমাদের বিশ্বাস এসময় তাকে বাসায় পাওয়া যাবে। এবং পাওয়াও গেল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দরজা খুলে আমাদের দেখে তিনি কী বুঝেন কে জানে। হয়তবা আমরা তার নতুন কল্পগল্প শুনতে বাসায় এসেছি এই ভেবে অন্য কোনদিন আসার কথা বলেন। আমরা কেউ অমত করি না তবে আসার সময় তাকে তার বাসায় আসার মূল উদ্দেশ্যের কথা বলি এবং এও বলি যে আমাদের আবেগ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আমাদের কথা শোনার পর তিনি খানিক ভাবেন এবং বলেন ‘ঠিক আছে একথা আপনাদের জানাবো কিন্তু আজ নয়। আসলে আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ। মাথা ধরেছে। শুয়ে আছে। কথা বললে ওর ঘুমে অসুবিধা হবে তাই আপনাদের বসতে বলছি না। ক্ষমা করবেন।’ আমারা ফিরে আসি আর অপেক্ষা করতে থাকি কবে তিনি আমাদের কৌতূহলের জবাব দেবেন। আমাদের কৌতূহলের দিন পেরিয়ে যায়। একদিন-দুইদিন-তিনদিন, একসপ্তাহ-দুইসপ্তাহ, একমাস-দুইমাস। এবার আমরা তার না ডাকার কারণ সম্পর্কেও উদ্বিগ্ন হই। পূর্বের মতো আবারো আমরা তার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হই কিন্তু এবার তাকে পাওয়া গেল না। বাসায় একেবারে তালা লাগানো। দাড়োয়ানকে ডেকে তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে জানা গেলো, তিনি এ বাসা ছেড়ে চলে গেছেন বেশ কিছুদিন পূর্বে। দাড়োয়ান তার পকেট থেকে একটা শাদা খাম বের করে দিয়ে বললো ‘গল্পকার সাব যাবার সময় এই খামটি দিয়ে বললেন যদি তাকে কেউ খুঁজতে আসে তবে যেন এই চিঠিটি দিই।’ আমরা দ্রুত তার আরো কাছের দিকে এগিয়ে আসি। ‘দিন, দিন আমাদেরই চিঠি।’ তারপর খাম খুলে ভেতরের চিরকুটটি বের করে আনি। তাতে লিখা:
২৩ মার্চ ২০১০ বাংলাদেশ, পৃথিবী, সৌরজগত
সুপ্রিয় কৌতূহলীগণ
আমার প্রণাম ও ভালোবাসা জানবেন। আপনাদের কৌতূহলে শেষমেশ সাড়া না দিয়ে পারলাম না। দেরিতে জবাব দেবার জন্য খুবই দুঃখিত আমি। আসলে নিজের সাথে পেরে উঠছিলাম না। তবু একবার মনে হলো আপনাদের কৌতূহলের জবাব দিয়ে যাই। প্রারম্ভেই বলে রাখি আমি কোনো তথাকথিত গল্পকার নই। আপন মনে কল্পনায় গল্প তৈরি ও বলাই আমার নেশা। দশ/এগারো বছর পূর্বে গ্রাম থেকে আসা এক যুবক আমি। মৌলভী পিতার সূত্রে ছয় ভাইবোন আমরা। সকলেই মেধাবী ছিলাম। প্রকৃতির করুণ সত্য ও আমার পুরনো অতীত হচ্ছে একে একে পাঁচটি ভাইবোনকে ক্যান্সার রোগে হারানো। প্রিয় ভাইবোনদের হারিয়ে একা হতে থাকলাম প্রকৃতিতে। ক্রমশ মানুষের করুণা, স্নেহ, ভালোবাসা-প্রার্থী হতে থাকলাম আমি। সেই একাকীত্ব থেকেই তৈরি হতে থাকলো আমার কল্পাখ্যান। গ্রামে আমার পিতামাতা সন্তান হারানোর প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে এখন বসবাস করছেন। আমি ছাড়া তাদের আপন কেউ নেই। নজিতা, সূচিতা, আপনারা এবং বন্ধু-বান্ধব সকলের তাগিদে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম যে, এখন থেকে নিয়মিত গল্প লিখবো। কিন্তু বাকি ছিল প্রকৃতির আরেকটি চূড়ান্ত সত্য জানার। তবে সত্য কিংবা অসত্য সে বিষয়ে আপনাদের কিছুই জানাচ্ছি না। কেননা এ বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে গেলে পিতামাতা ও নববিবাহিত সূচিতার আর কোনো সান্ত্বনা থাকবে না। সেজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে গ্রামেই থাকবো বাবা-মার সংগে। আর উপভোগ করবো জীবনের চূড়ান্ত গল্পটির এক একটি পঙতি লিখিত হবার প্রসববেদনা। আপনাদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও শুভকামনা।
বিরল কাহন

ভ্রুণহত্যা, বিড়ালহত্যা কিংবা মধ্যবিত্ত নিতিদিন

তন্দ্রার মনযোগ ভাঙে দূরের একটি ট্রাকের গর্জনে। সে মৃদু আলোর দিকে তাকায়, খানিকটা দূরে, ট্রাকের আলোয় রাস্তার মাঝখানে শুয়ে থাকা একটি বিড়াল স্পষ্ট হয়। সম্ভবত প্রচণ্ড গরমের কারণেই বিড়ালটি এমনভাবে রাস্তায় বসে আছে একটু খোলা হাওয়ায় শীতল হবে বলে। বিড়ালটিকে তন্দ্রার আদর করতে ইচ্ছে করে, ভাবতে ভাবতে ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে আসা দূরের ট্রাকটি মুহূর্তেই বিড়ালটিকে চাকায় পিষ্ট করে আঁধার করে দিয়ে যায়। ল্যাম্পপোস্টের নিচে পড়ে থাকে ২৫০ ভোল্ট বাতির মৃদু আলো। বিড়ালটির মৃত্যু তন্দ্রার ভারাক্রান্ত মনে একটু বড়সড় ধাক্কা দেয়, একি তবে বড় কোন দুর্ঘটনার আভাস।
সুপ্ত’র সঙ্গে তন্দ্রার প্রেম করে বিয়ে হয়নি। ওদের বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিকভাবেই তবে বিয়ের আগেই তারা একে অপরকে দেখেছিল কয়েকবার। কলেজ ক্যাম্পাসে দু’জনের প্রথম কথা হয়। লেকের ধারে বসে দীর্ঘক্ষণ নিরবতা শেষে তন্দ্রার হাতে সুপ্তর স্পর্শ যেনো একরাশ কথার সজীবতা দিয়ে যায়। তারপর এই সংসার; বিয়ের সময় অবশ্য তার দু’একজন বিবাহিত বান্ধবী পরামর্শ দিয়েছিল দেখিস, পুরুষ মানুষের মন একটু বুঝে শুনে চলিস, সবকথা পুরুষকে বলতে নেই, সবকথা পুরুষের ধাতে সয় না। কথাটি তন্দ্রার মূর্খ সংস্কৃতি মনে হয়, সবকথাই যদি বলা না যায় তবে আর দুয়ের বন্ধন কেন!
ভাবতে ভাবতে রাত্রি দ্বি-প্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে, তন্দ্রার চোখে ঘুম নেই, ঘুম আসছেও না। ফলে দোতলার উত্তর দিকের জানালা খুলে দিয়ে সে বড় রাস্তার মৃদু আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এ সময়ও হঠাৎ হঠাৎ মৃদু আলোয় মানুষের আসা-যাওয়া প্রত্যক্ষ হয় আবার কখনও কখনও মালবাহী দু’একটি ট্রাকের গর্জন মনযোগ ভাঙে। এই তো ক্ষাণিক আগে রাস্তার একটি বিড়ালকে চাপা দিয়ে গেছে একটি ট্রাক। ট্রাকের ড্রাইভারটি নিশ্চয়ই একজন মানুষ কিন্তু কেমন মানুষ। এরকম ফাঁকা রাস্তায় কেউ এভাবে বিড়ালটিকে হত্যা করতে পারে, নিজের কাছেই প্রশ্ন করে তন্দ্রা।
সুপ্ত সকালবেলা নাস্তা করে বেরিয়ে গেছে অফিসে, এখনও ফেরেনি। সবেমাত্র তিন-চার মাস অতিক্রান্ত হয়েছে ওদের বিয়েরকাল। এখনি সুপ্তর মন বাইরে চলে গেছে, খুব সাধারণ একজন মেয়ের মতো সেও এইকথা ভাবে। অথচ জীবনটাকে খুব সহজ করে নিয়েছিল সে নিজের মতো। সারাটা জীবন কি তবে এভাবেই কাটাতে হবে, খুব আফসোস হয় তন্দ্রার। তার বিবাহিত বান্ধবীদের কথা মনে পড়ে। ওদের কারও কারও বিয়ের বয়স তিন-চার বছর পেরিয়ে গেছে তবু ওদের স্বামী সম্পর্কে মধুর কথা শোনে নিজেকে দুর্ভাগ্যবতী মনে হয়। তার কষ্টটা বাইরে প্রকাশ করার মতো নয় নিজে কাছে সওয়া ছাড়া। কাকে বলবে সে, সেই একটি ঘটনাই তাকে বারবার অবদমিত করে রাখে। কেন সে এমনটি করেছিল তার আজ কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। আজ তো জীবনের মানেই অন্যরকম বোধ হচ্ছে। নিজের কাছেই নিজেকে আরও বেশি অপরাধী মনে হয়। তার কিবা দোষ ওটা তো বয়সজনিত ঘটনা, তাছাড়া সে নিজেও বুঝতে পারেনি কিভাবে ওটা ঘটেছিল। আজ বুঝে, ওরকম আবেগ ও বিশ্বাস কখনও কখনও ভাল নয়। পুরনো স্মৃতি তাকে ভারাক্রান্ত করে, কখন যে অতীতমন্থনে ডুবে যায় তার মন সে নিজেও জানে না। একটি মুখোশ তার দিকে স্পষ্ট হয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। সে রাগে, দুঃখে মনে মনে ভাবে মুহূর্তেই আগুন জ্বালিয়ে দেবে মুখোশটির শরীরে, কেন ওভাবে তাকে প্ররোচিত করেছিল।
ক্রমশ মুখোশটি অস্পষ্ট হতে হতে আবার ভেসে ওঠে বান্ধবীদের মুখ। আজ তাদের কথাই সত্যি মনে হয় নইলে সেই ঘটনাটি শোনার পর থেকে সুপ্ত এত মনমরা হয়ে আছে কেন। তন্দ্রার চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল, আধোঘুমের লেশলাগা চোখেই সে রাস্তার দিকে তাকায় এবং মুহূর্তেই তন্দ্রালু চোখ ভেঙে দিব্যজগতে ফিরে আসে সে। সুপ্তর আগমন দৃশ্যটি আজ তার কাছে অন্যরকম মনে হয়। সুপ্ত কি আজ মাতাল হয়ে ঘরে ফিরছে। সাধারণত এ অবস্থায় পুরুষরা মদটদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে। কলিংবেল বেজে ওঠার আগেই সে নিচে গিয়ে দরজা খুলে দেয়, স্বচ্ছ হয়ে ওঠে সুপ্তর মুখ; কান্ত, তন্দ্রালু আর হাজার প্রশ্নের বাণ যেন চোখ বেয়ে নেমে আসে তন্দ্রার দিকে। তার ভীত শরীর হাল্কা গরম আর ভয়ার্ত প্রতিবেশে ঘামতে শুরু করেছে। সুপ্ত কোন কথা না বলে ভেতরে প্রবেশ করে, দরজা বন্ধ করে পেছনে পেছনে দোতলায় ওঠে তন্দ্রা। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে কোট-টাই খুলে সুপ্ত। তন্দ্রার ইচ্ছা হয়, প্রতিদিনের মতো আজো কোট-টাই খুলে দিতে কিন্তু সাহস হয় না। কোন এক অক্টোপাস যেন শীতল করে রেখেছে তার হাত-পা-মুখ। হাল্কা ট্রাউজার পরে বাথরুমে প্রবেশ করে সুপ্ত। ক্ষাণিক পর ফ্রেশ হয়ে ফিরে আসে কিন্তু তার চোখে-মুখে হাল্কা কান্তির ছাপ রয়ে গেছে, আয়নায় চুল আঁচড়িয়ে বিছানার দিকে যায় এমন সময় কথা ফোটে তন্দ্রার।
টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে, খাবে চল।
খাব না, বলেই সুপ্ত বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। তন্দ্রার রাতের খাবার খাওয়া হয়নি, কথা না বাড়িয়ে সেও বিছানায় গা ছেড়ে দেয়, কিছুক্ষণ ভাবে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা? তারপর প্রশ্ন করে...
দুপুরে খেতে এলে না যে?
ইচ্ছে হয়নি, সুপ্তর সহজ উত্তর।
ক’দিন যাবত তুমি এমন করছ, কি এমন দোষ করেছি যে...। তন্দ্রার কথা শেষ হতে না হতেই সুপ্তর স্বাভাবিক ঝাঁঝালো স্বর...
দেখ, এই মাঝরাতে কোন সিনক্রিয়েট করতে চাই না। যা হয়েছে তা মামুলি বিষয়, খুবই স্বাভাবিক কিন্তু চেপে রাখা আরও বেশি অস্বাভাবিক। আমাকে তাই করতে হচ্ছে, এরকম বিপাকে পড়তে হবে কোনদিন ভাবিনি আমি। এত রাতে রুমে বাতি জ্বালানো থাকলে, বাবা-মা চলে আসতে পারেন। বাতিটা নিভিয়ে দয়া করে একটু শান্তিতে ঘুমোতে দাও। তন্দ্রা আর কথা বাড়ায় না, ধীরে ধীরে ওঠে বাতিটা নিভিয়ে দেয়। তারপর শেষ রাত্রে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে দু’জন কেউ জানে না।
মন: মনুষ্য ধারাবাহিকতায় একটি জটিল বিষয়। মিরাকল। সে কখন কোথায়-যে যায় তার কোন ঠিকানা নেই। বিড়াল, বারো ঘরের পাতিলের গন্ধ শুঁকে শেষে উগাড়ের ইঁদুর নিয়ে যার রাত্রিবাস। এখানেই জীবনের সম্পর্ক জড়িত, আমাদের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সবখানেই রয়েছে মনোবিত্ত কিংবা নেই। এই আছে ও নেই এর মধ্যে আমাদের আজন্ম বসবাস, এই কথা হয়েছে জানা।
সুপ্ত ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু তন্দ্রার চোখে ঘুম নেই। ঘুম আসছে না। নুসরাত আপুর কথা স্মরণ হয় তার। প্রতিবেশী। বড়বোন শুভ্রার বান্ধবী। বিয়ের কিছুদিন পর হঠাত একদিন বাড়ির বাঁশঝাড়ে গলায় দড়িবেঁধে আত্মহত্যা করলো সে। সবাই অবাক, নুসরাত এরকম করলো কেন? পরে, বাড়ির লোকজনের কানাঘুঁষায় আসল ঘটনাটি জেনেছিল তন্দ্রা। নুসরাত তখন হাইস্কুলের ছাত্রী। ওদের বাড়িতে একজন গৃহশিক্ষক থাকতো। এই শিক্ষকের সাথেই বাড়ির সকলের অজান্তে নুসরাতের প্রেমের সম্পর্ক হয়ে যায়। সম্পর্ক এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, একে-অপরের দেহদানে সঠিক হিসেবের অবকাশ হয়নি কারোর। একসময় অসতর্ক নুসরাত সন্তান সম্ভবা হয়ে যায়। ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে বাড়ির লোকজন জেনে গেলে কোন একরাতে নুসরাত-কে স্থানিয় এক হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এবোরশন করিয়ে আনে। ঘটনাটি প্রতিবেশী কেউ বুঝে ওঠার আগেই বাড়ির লোকজন ওই গৃহশিক্ষক-কে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দেয়।
তার বছর পাঁচেকের মধ্যেই বিয়ে হয় নুসরাতের। বিয়েরাতেই বরের কাছে ঘটনাটি জানিয়ে দিয়েছিল নুসরাত। ঘটনাটি জানার পর ওর বর আর তাকে বউ হিসেবে রাখতে চায়নি। ফিরতি নাইয়রের নামে নুসরাত-কে বাড়ি রেখে গিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয় ওর বর। অসহায় নুসরাত ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে না পেরে শেষমেষ গলায় দড়ি বেধে আত্মহত্যা করে।
শুভ্রাকে মানুষ বলে মনে হয় না তার। ওইরকম সময়েই তো অহনের সাথে তন্দ্রার অনেকটা প্রেমের মতোই ঘটনাটি ঘটেছিল। অহন শুভ্রার ভাসুরের ছেলে। সুদর্শন যুবক। ওইরাতের ঘটনাটি মনে পড়ে তন্দ্রার। শুভ্রার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। রাতে তন্দ্রা আর অহন একসাথে ছিল। ছেলেটা খুব পাগল, অস্থির আর উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। তন্দ্রা নিজেও খুব সম্মোহিত আর চড়ম লোভী হয়ে ওঠেছিল সে রাতে। ভাবতে ভাবতে খুবই লজ্জাক্রান্ত হয় তন্দ্রা। ঘুমন্ত স্বামীকে পাশে রেখে এসব ভাবতে ভালো লাগে না তার। তাছাড়া তার চিন্তা ঘুমন্ত সুপ্ত আবার টের পেয়ে যাচ্ছে নাতো! সে রাতের নিজস্ব আলোয় সুপ্তর দিকে তাকায়। সুপ্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। ফ্যানের হালকা বাতাসেও সুপ্তর শরীর মৃদু ঘর্মাক্ত। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু জলের স্থির সন্তরণ। জনশ্রুতির কথাটি মনে হয় তার। যে পুরুষের নাক বেশি ঘামে সে পুরুষ খুব বউ-আদরের হয়। সুপ্তকে আদর করতে ইচ্ছে হয় তার কিন্তু পারে না। ঘুমন্ত স্বামীকে আদর করে দিতে কেমন যেন গর্হিত অপরাধবোধ আটকে রাখে তাকে। মনে ভাবে, সুপ্তর মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে ওঠলে ওকে ইচ্ছেমতো আদর করে প্রমাণ করবে জনশ্রুতির কথাটি আসলেই ঠিক।
অন্ধকারের আলোতেই মুখোশটির অস্তিত্ব টের পায় তন্দ্রা। মুখোশটি তার চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে আর প্ররোচিত করতে থাকে। পালিয়ে যা তন্দ্রা, পালিয়ে যা, দূরে কোথাও। নইলে শান্তি পাবি না। পালাবার এখনই সময়। তন্দ্রা ভাবে সত্যি সত্যি সে পালিয়ে যাবে কিনা। গেলে কেমন হয়? একেবারে অজানায়, দূরে, অনেক দূরে। নুসরাতের কথা মনে হয় তন্দ্রার। তারমতো সেও কী দূরে কোথাও গিয়ে আত্মহত্যা করবে নাকি। আবার ভাবে আত্মহত্যা করবে কেন? সে সুপ্তকে ভালোবাসে আর সুপ্তও তাকে, তাই তার আত্মহত্যা করা ঠিক হবে না। অস্থির হয়ে ওঠে তন্দ্রা, তার শরীরও ঘামতে থাকে। মুহূর্তেই সে মুখোশটিকে ধরে ফেলতে চায় কিন্তু ধরতে পারে না। অন্ধকারেই মুখোশটি একবার তার পাশে আসে... একবার সোফায় গিয়ে বসে... একবার সুপ্তর কম্পিউটার টেবিলে গিয়ে বসে... একবার জানালার পাশে দাঁড়ায়... একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়... মুখোশটিকে সে যেন কিছুতেই ধরতে পারে না। ঘর্মাক্ত তন্দ্রা বিছানা ছেড়ে টেবিলের দিকে যায়। জগভর্তি পানি থেকে একগ্লাস পানি খায় সে। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। নির্জন রাস্তায় স্ট্রিট লাইটের ২৫০ ভোল্ট বাতির মৃদু আলো আর ট্রাকচাপায় থেতলে যাওয়া বিড়ালটিকে দেখতে থাকে সে।
সকালে নাস্তার টেবিলে দুজনেই চুপচাপ থাকে যেন একে-অপরকে কেউ চেনে না। অন্যান্য দিন তন্দ্রা নিজ হাতে ব্রেড-এ জেলি মেখে খেতে দিয়েছে কিন্তু আজ দিচ্ছে না, নিজেও নিচ্ছে না। হঠাত সুপ্ত উত্তেজিত হয়ে কোনো সিনক্রিয়েট করে ফেলে সেই ভয়। তন্দ্রা কী রাতে ঘুমিয়েছিল? বোধ হয় না, ওর চোখ দেখে বোঝা যায়। হয়তবা রাতে কেঁদেও ছিল। নাস্তা সেরে সুপ্ত রমে ফিরে অফিস যাবে বলে প্রস্তুত হয়েছে, এমন সময় তন্দ্রা এসে সামনে দাঁড়ায়।
তোমার সাথে কথা আছে।
বল, সুপ্ত’র উত্তর।
আমি বাড়ি যাব।
এবার সুপ্ত মনযোগী ভঙ্গিতে আরেকটু সামনে এগিয়ে তন্দ্রার মুখোমুখি হয়।
এখানে কী খারাপ লাগছে? হেভ য়্যু ফিল বোরিং হিয়ার!
এমন একটি সিরিয়াস বিষয়ে সুপ্ত’র হেয়ালিপনার অর্থ তন্দ্রা বুঝতে পারে না, সে উত্তরহীন তাকায়।
ওকে, ওকে ইফ য়্যু ফিল বোরিং অর ডিজগাস্টিং দেন য়্যু কেন গো বাট নট উইদাউট মি। আই ওয়ান্ট টু গো উইথ য়্যু ফর রিচড্ এন্ড এ পিচফুল এরেঞ্জমেন্ট ফর য়্যু দেয়ার। হেভ য়্যু আন্ডারস্ট্যান্ড ডেয়ার অনারেবল মেডাম। এই বলে তন্দ্রার মুখটা দু’হাতে একটু উঁচিয়ে ধরে নিজের খুব কাছাকাছি এনে সম্মোহনের মতো তাকায় সুপ্ত। তন্দ্রা কিছু বুঝতে পারে না, সে সুপ্তর দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথম দিনের মতো, মহাজাগতিক জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে। ফাঁকে, কখন যে সুপ্ত তার ওষ্ঠে একটা চুম্বন দৃশ্য এঁকে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়, ঠাহর হয় না তন্দ্রার।
বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে গ্রামের মেয়েরা যে রকম বৃষ্টিতে ভিজে সজীবতা উপভোগ করে, তন্দ্রাও সেই সজীবতা ফিরে পায়। বুঝতে পারে, কী ভুলটাই না সে করতে বসেছিল। মতিভ্রমে মানুষের এরকমই হয়। তার মুখে তখনও ভাষা ফুটেনি, ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে সুপ্তকেও সে একটি চুম্বন করে আসে কিন্তু পারে না, প্রথম দিনের মতো বহুকালের অচেনা বোধ কাজ করে। আজন্ম নারীজনমের লজ্জাবোধ তাকে আটকে রাখে।
অফিসে ফিরেই সুপ্ত নিশ্চিত টেলিফোন করবে, তন্দ্রা জানে। তাই রুমেই থাকে, এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে, বই পড়ে, টেলিভিশন অন করে কিন্তু ভালো লাগে না, সিডি প্লেয়ার অন করে লোপামুদ্রা মিত্রের গান শোনে ‘ছেলেবেলার বৃষ্টি মানেই আকাশজোড়া...’ গরম পড়েছে তবু এই গান খারাপ লাগে না; স্মৃতিমন্থন হয়। ফ্যানটা ছেড়ে সে উত্তরের জানালাটা পুনরায় খুলে দেয়। খুলতে খুলতে মনে পড়ে বড় রাস্তায় গতকাল রাতে একটি বিড়াল ট্রাকচাপা পড়েছিল। তার থেতলে যাওয়া চিহ্ন এখনও স্পস্ট হয়। বিড়ালটির কোনো দোষ ছিল না, সেই ভ্রুণটিরও... পুনরায় তার সেই ছায়াটির কথা মনে হয় কিন্তু দিনের শ্বেতশুভ্র আলোয় তাকে দেখতে পায় না সে। তন্দ্রা জানে এবার যদি তাকে সামনে পায় সে নিশ্চিত গলাটিপে হত্যা করবে।

মোহিনীবিবর

চোখ সকলকে দেখে, নিজেকে দেখে না
দেখে না, কারণ তার চারপাশ অন্ধকারময়

স্বয়ং চোখের এই পরিণতি দেখো- চক্ষুষ্মাণ কিন্তু অন্ধ

মানুষ নিজেকে ঠিক ততটুকু জানে
বেদনায় শরীর ভিজিয়ে ভাবে, বৃষ্টিতে ভিজেছে
এইভাবে চল্লিশটি আকাশ পেরিয়ে
উঠে যায় অন্য কোনো আকাশের খোঁজে

নিজেকে যায় না দেখা, এইকথা সব চোখ জানে
মানুষ জানে না

অগোছালো জীবন এখন প্রাত্যহিক নিয়ম তার, অবশ্য এই অবস্থাটা বাহির থেকে বোঝার নয়। গুছিয়ে থাকতে তারাই চায়, যাদের জীবন অগোছালো। বিকেলবেলা ঘরে ঢুকে মনে হলো তার...। এই সময় হঠাৎ-ই বা কেন ঘরে ঢুকলো সে? এ দুপুরে রিজন, ইকবাল, তাজ, কাঞ্চন, সাগর, এরা এসেছিলো, সবাই মিলে নিমাই টেনেছে; মাথাটা পাহাড়ের মতো ঝিম মেরে আছে। এবার মনে পড়েছে নিমাই টানার পর সে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো- এখন ফিরেছে কিন্তু কেন তা মনে করতে পারছে না। পেটে হালকা ক্ষুধা অনুভব করছে, ভাবে, সকালে রান্না করেছিলো কী? ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে যায়... ভাত আছে আর তরকারির পাতিলে একটা ডিম ভুনা করা; কোনো কিছু ভাববার আগে পেটটাকে শান্ত করার জন্য এখনই খেয়ে ফেলার দরকার। প্লেটটা ধুতে গিয়ে ঘরের কোণে চোখ পড়ে শিমেলের। পড়ন্ত বিকেলের কান্তি নিয়ে পড়ে আছে একটা ফুলগাছ, তাতে সদ্যফোঁটা প্রাণহীন একটি ফুল ঘুমন্ত অবস্থায়। কিন্তু এই গাছ এখানে এলো কী করে? নিশ্চয়ই পাশের বাসার নাক উঁচু বাঁদর মেয়েটার কাজ। সারমিন সোমা। সদ্য অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে সে, তাই এতো ফুটফুটানি। দেখতে ঠিক ঐশ্বরিয়া রাইয়ের মতো কিন্তু নাকটা রাবিনা ট্যান্ডনের মতো উঁচু। ঐশ্বরিয়াকে তার খুবই পছন্দ, ওইতো তার লেটেস্ট মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটাও সে দেখেছে কয়েকবার। ‘গুরু’। কিছুদিন আগে রাতে সে প্রায়ই ঐশ্বরিয়াকে স্বপ্নে দেখতো... এই ঘটনা বন্ধুদের বলার পর তারা খুব হাসাহাসি করেছিল। শালা গাধার মাথাটাই গেছে নেশা করে। জীবন এরকম সত্যি হয় নাকি, ওসব ভাবতে নিজেরও লজ্জা হয়। নাক উঁচু মেয়েটার কথা মনে হয় তার। প্রথম যেদিন সে এই ভাড়া বাসায় এসেছিল সেদিন রাতেই ঘরে ঢোকার সময় চোখে পড়ে একটি আধপচা লাউ দরজায় ঝুলানো। এরকম প্রায়ই থাকতো। প্রথম কিছুদিন আঁচ করতে পারেনি- পড়ে বুঝতে পারে এটি ওই বাঁদর মেয়েটার কাজ। এখন আর ওরকম করে না, কি জানি এই একাকিত্ব জীবন দেখে তার মায়া জেগেছে কিনা! টেররদের জন্য কারও মনে ভালবাসা সঞ্চিত থাকে এই সত্য উপলব্ধি করার মতো কোনো একটি দিন তার সামনে এসে উপস্থিত হয়নি, ফলে তার কল্পনা, কল্পনাই রয়ে গেছে। টেরর সন্তানদের জন্য পিতামাতারও মনে কোনো দরদ থাকে কিনা তাও বোঝার মতো কোনো সুযোগ হয়নি তার হয়ত দরদ বেশিই থাকে খারাপ সন্তানদের জন্য। মা মারা গেছে চার / পাঁচ বছর হয়, বাবাও পরে বিয়ে করেছে তিন / চার বছর হয়ে যায়; বিমাতার কারণেই তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। এসব মনে হতে হতে চোখ দুটি জলসিক্ত হতে থাকে, কেমন আছে ছোটভাইটি... না জানি কত কষ্টে আছে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাবা বলে দিয়েছিলো যেন আর ফিরে না যায় বাড়িতে, যদি যায় তবে খুন করে ফেলবে। মা নেই তাই বাড়ি ফিরে কি লাভ? এই ছিল প্রথমের সান্ত্বনা কিন্তু ছোট ভাইটি মাঝে মাঝে এসে দেখে যায। এলেই সিনক্রিয়েট হয়, জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি... পিতামাতার অতি আদরের দুটি ভাই ছিল তারা। আজ তারাই কিনা মানুষের গঞ্জণায় বেড়ে ওঠছে পৃথিবীতে; একজন বিমাতার ঘরে আর সে প্রাণহীণ শহরের মানুষজনের অনাদরে।
জীবনের এই দুর্বিষহ যন্ত্রণার ভেতর থেকে তার কোমল মনটি এখন বেরিয়ে যেতে চায় কোনো এক অপরিচিত ভালবাসার কাছে... যেখানে চারপাশে শুধু ভালবাসা ঘিরে থাকে, থাকে নাকি? হয়ত থাকে, শিমেলের জানা নেই। গোধূলিবেলায় নদীর ধারে গিয়ে বসে আর মনে মনে প্রিয় কবির নাম কবিতার পঙক্তি আওড়ায় ‘নষ্টদের কোনো কষ্ট থাকে না।’ সত্যি কি তাই! নাক উঁচু মেয়েটির কথা মনে পড়ে... দূরে যে দাঁড়িয়ে থাকে... দেখে পলকের পর পলক... উপড়ে ফেলা ফুলগাছটি আবার যার নামে পুঁতে রেখেছে সে, মনে ভাবে যদি ভালবাসা থাকে তবে চারাটি বেঁচে ওঠবে। কিন্তু কার জন্য, টেররদের কেউ ভালবাসে নাকি! টেররদের মন আছে এ কথায় বিষ্মিত হয় আমাদের দেশের মানুষজন!
‘জীবনও আঁধারে পেয়েছি তোমারে চিরদিন পাশে থেকো বন্ধু’ কাঞ্চন গান ধরে গোধূলি সন্ধির নৃত্যে। ইকবাল বলে তুই বড় বেরসিক রে বাবা, এ সময় এমন গান কেউ গায়? এরকম সময়ে ‘দিবসও রজনি আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি’। তারপর শিমেলকে বলে, ধর না বাবা গানটা, সন্ধেটা জমে ওঠবে। আমাদের তো আর টিএসসি, চারুকলা, নাটক সরণি, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, জাতীয় সংসদ নেই আমরা বরং এখানে বসেই গোধূলি কল্যাণ সংঘের কথা ভাবি। শিমেল নিশ্চুপ থাকে। কাঞ্চন ইকবালকে বিরক্তির ঢঙে বলে তুই বড় পেঁচগি রে বাবা। টাডি সুপারি আর মাল্টিমশলায় তৈরি পান খেলে নাক-মুখ-কান যেরকম গরম হয়ে আসে সেরকম নেশাটা ধরেছিল মাত্র। শান্তিমতে গানটা গাইতে দিলি না। যাক, খাসা মোহিনীর তরতাজা একটা কলি থাকলে থুথু দিয়ে কসিয়ে একটা সিগারেট বানিয়ে ফুঁকতে পারলে পুনরায় গানে ডুব দেয়া যেত রিজন, তাজের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে কাঞ্চন।
আমাদের কাছে হেস্ নাই রে দোস্ত রিজন, তাজের জবাব। সাগর না এলে দ্বিতীয়বারের মতো মাইনক্যা আড্ডা দেয়া যাবে না বোধহয়। কাঞ্চন একটু অবাক হয়ে নড়েচড়ে বলে তাইতো সাগর শালা আজ এখনো আসেনি। এ এক জোতিষ পরাণ, অল্পসল্প দৈনিকী সংবাদ, পাড়ার খোঁজ-খবর আর ছোটখাটো ঝুট-ঝামেলা মেটাতে না পারলে যেন সে সাগরই নয়। বলতে বলতে সাগর এসে উপস্থিত। মোহিনীবিবরের প্রত্যাশায় সবাই সাগরের দিকে তাকায়।
পালাইছে, নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে কথাটি না বলে সাগর আড্ডায় সমবেত হয়।
সকলের বিষ্ময়সূচক প্রশ্ন, কে পালাইছে?
ঐশ্বরিয়া, সাগরের জবাব।
সবাই শিমেলের দিকে তাকিয়ে সাগরকে বলে, বালখিল্যতা করিস না, সত্যিই পালাইছে?
আমি কী তবে মিথ্যে বলছি নাকি? সাগর উত্তর দেয়। বিকেলবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে একটা মাল কিনতে গেছি। সেখানে রাফির সাথে দেখা, সেই প্রথম খবরটা দিয়েছে। পরে নানার দোকানে চা খেতে খেতে ফাঁকে নানার কাছে ডিটেল জানলাম। ঐ যে ঘুরঘুর করতো না ঢাকায়া ছেলেটা, তার সাথেই পালাইছে।
এবার কাঞ্চন ওঠে বসে, শিমেলের দিকে একবার তাকায়; বলে, যাক বাবা বাল দিয়ে চেন হয় হলো তাহলে। বাল হলে চেন হয়, চেন হলে বাল হয় এইতত্ত্বে আমার বিশ্বাস ছিল না, আজ হলো। পাখি তো ফুট্ রে এবার তোর কী হবে?
আমার কী হবে মানে? শিমেল বলে।
তোরা না, না বুঝে অযথাই এ ব্যাপারে আমাকে জর্জরিত করিস।
বারে! তুই না প্রেম করবি বলে ছিঁড়ে ফেলা ফুলগাছটা ওর নামে লাগিয়েছিলি?
ভালোবাসা থাকলে ফুলগাছটা বেঁচে ওঠবে, এই শর্তে লাগিয়েছিলাম, ওর সাথে প্রেম করবো বলে নয়, শিমেলের উত্তর।

আকতার ভাই আড্ডায় আসলে শিমেলের মনটা অন্যরকম ফুরফুরে মেজাজে থাকে। আকতার জামিল। পেশায় সাংবাদিক, হিমু স্বভাবেব আড্ডায় স্বতোঃস্ফূর্ত মজার মানুষ। গতকাল এসেছিলো। রাতভর চুটিয়ে কার্ড খেলে সকালে শিমেলকে নাস্তা করিয়ে কাজ আছে বলে চলে গেছে। যথারীতি নিত্যবিবরের মানসিকতা নিয়ে ঘরে ঢুকে শিমেল। উন্মুক্ত ঠিকাদারির কিছু কাগজপত্র ফাইলে গুছিয়ে নেয়। অফিসপাড়ায় কিছু ঠিকাদারি ধান্দা আছে। ছোটখাটো ছিঁচকে টেররগোছের পরিচয়ধারী ছেলেদের অফিসপাড়ায় বসদের সেক্রেটারির কাছে কদর একটু কমই থাকে আর সামাজিক অবস্থানটা তো খুবই বাজে হয়। শিমেল অবশ্য এর ব্যাতিক্রম, স্বাভাবিক ভদ্রতায় সে অফিসপাড়ায় তার উন্মুক্ত ঠিকাদারি কাজটা চালিয়ে নিতে পারে। তবু বিবিধ যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে ভাবে সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে বহুদূর অজানা কোথাও চলে যাবে। কিন্তু যাবে কোথায় আর গিয়েই বা কী করবে? তারচে এই ভালো ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না’।
সেলফোনে মুসোলিনির কল, বিষ্মিত শিমেলের প্রশ্ন, এতদিন পরে তুই, কিরে? কোত্থেকে? কেমন আছিস?
আমি আর সাগর জয়নুল সংগ্রহশালার সামনে বসে আছি, তুই দ্রুত পার্কে চলে আয়।
এখনি আসছি বলে, কল রাখে শিমেল।
সগির উদ্দিন। অসম্ভব ডানপিঠে, বদমেজাজি আর হিটলারি বুদ্ধির সিভিল সার্জন। শিমেলদের আড্ডায় সকলের চেয়ে দু-তিন বছরের বড় ছিল। ওর কার্যকলাপের জন্যই সবাই তাকে মুসোলিনি বলে ডাকতো। শিমেলের এই অগোছালো জীবন, তাস খেলা, মোহিনীবিবরের সূত্রমুখও তৈরি হয়েছিল এই সগির উদ্দিন মুসোলিনির মাধ্যমে।
শিমেল বাসা থেকে বেরিয়ে নানার দোকানে গিয়ে চা-সিগারেট খেতে খেতে নানা-কে মুসোলিনির খবরটা দেয়। নানা বৃদ্ধ বয়সেও যেন এসব উদ্ভট তরুণদের উৎকট যাপিত জীবনের বৈচিত্রতায় নিত্যই চাঙ্গা হয়ে ওঠেন।
রিক্সায় জয়নুল সংগ্রহশালার দিকে যেতে যেতে একটি ঘটনার কথা স্মরণ হলো শিমেলের। কলেজে থার্ড ইয়ারের বার্ষিক পরীক্ষা। রুবি মেডাম তখন অন্ত:সত্ত্বা। ডেলিভারির ডেটও খুব নিকটে চলে এসেছিল বোধহয়। ঐ অবস্থায়ই মেডামের ডিউটি পড়ে আমাদের হলে। বিষয়টি কী হয়েছিল বন্ধুদের কেউ বুঝতে পারেনি। পরীক্ষা চলাকালিন সময়ে ম্যাডাম রুম থেকে যান এবং জুলফিকার স্যারকে ডিউটিতে পাঠান। ইংরেজির শিক্ষক তার উপর খুব রাগি। স্যার হলে এসে মুসোলিনির পরীক্ষার খাতাটি নিয়ে নেন এবং ইংরেজিতে খুব কড়া গালিগালাজসহ তাকে হল থেকে বের করে দেন। পরে ঘটনাটি মুসোলিনির কাছ থেকেই জানা হলো। পরীক্ষার সময় সে নাকি তার আন্ডারওয়্যারবিহীন প্যান্টের জিপার খুলে লিঙ্গদেশ হা-করা মুখের মতো চুল বের করে বসে পরীক্ষা দিচ্ছিল এবং এক পা রেখেছিল বেঞ্চের বাইরে। ম্যাডাম যখন তার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ডিউটি করছিলেন তখন নাকি সে বলেছিল, ম্যাডাম একটু দেখেশুনে হাঁটাচড়া কইরেন, পড়ে গেলে তো আবার আপনার সমস্যা হবে। মুসোলিনির আর ডিগ্রি পরীক্ষা দেয়া হয়নি। সে বছরই সে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। একেবারে সুন্দরবন। দশ-পনের দিন পর ফিরে আসে। এসেই বন্ধুদের মাঝে উদ্ভট কথা ছড়ায়। সুন্দরবন গেলে প্রিয় মানুষের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। মুসোলিনির বাবা ছিল না, বড় ভাইদের সংসারে বেড়ে ওঠা ছেলে সে।
তুই সুন্দরবন যাবি? শিমেলকে জিজ্ঞেস করে মুসোলিনি। প্রিয় মানুষের ডাক শুনতে পাবি, একদম জীবন্ত ডাক। আচ্ছা তোর প্রিয় মানুষ কে রে, বাবা না মা?
প্রিয় মানুষের ডাক শুনতে পাওয়ার বিষয়টি শিমেল বুঝতে পারে না। সে মুসোলিনির দিকে অবাক ভঙ্গিতে তাকায়, বলে, আমি ওসব বিশ্বাস করি না।
তুই এইসব বুঝস্ রে মূর্খ, তুই এইসব বুঝস্ বলে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দেয়। ধর, নে, খা মোহিনী দিয়ে বানানো খুব মজা পাবি, আনন্দ পাবি, ফিলিংস হবে তোর।
এর কিছুদিন পর আবার বাড়ি থেকে উধাও। অনেকদিন কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি মুসোলিনি কোথায় আছে। বছরখানেক পর খবর পাওয়া গেল সে সিরাজগঞ্জ আছে, তাড়াশে, ওখানে বিয়ে করেছে।

দুপুরের হালকা গরমে গাছের ছায়ায় ইকবাল, রিজনসহ আড্ডারত মুসোলিনিকে ক্ষাণিক দূর থেকেই আবিষ্কার করলো শিমেল। সবমিলিয়ে মুসোলিনিকে একটু উজ্জ্বলই মনে হলো তার। দীর্ঘদিন পর বন্ধু-দর্শনের জন্য উদগ্রীব সে কাছাকাছি গিয়ে একটু অবাক হলো, সকলের মাঝে একজন শিশু আড্ডারুও আছে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে শিমেল বুঝতে পারে বাচ্চাটি মুসোলিনির। শিমেল মুসোলিনিকে জড়িয়ে ধরে এবং খুবই আবেগাপ্লুত হয়। দুজনের স্বাভাবিক কুশল বিনিময় শেষ হলে হালকা রৌদ্র-ছায়ায় আপন মনে খেলতে থাকা শিশুটির দিকে তাকিয়ে মুসোলিনিকে জিজ্ঞে করে শিমেল, তোর ছেলে?
হ্যাঁ, হিমেশ। হিমেশ রেশমিয়া, আমার ছেলে।
সম্মোহনের মতো হিমেশের দিকে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে থাকে শিমেল। হিমেশকে তার নিজের সন্তানের মতো মনে হয়। সে হিমেশের সামনে আদরের ভঙ্গিতে বসে কিন্তু তার স্বাভাবিক আদরের সঞ্চারণে আত্মমগ্ন-ক্রীড়ারত হিমেশের হৃদয় সঞ্চারিত হয় কিনা উপলব্ধি হয় না শিমেলের। সে মুসোলিনিকে জিজ্ঞেস করে ভাবি আসেনি?
-এসেছে।
-তাহলে এখানে নিয়ে আসিস্নি কেন?
-দুপুরের এই রোদে প্রশান্তির একটি আড্ডা হবে না তাই ওকে বাসায় রেখে এসেছি।
সকলেরই একপর্ব মোহিনীসম্ভাষণ হয়েছে, অনুমিত শিমেলের তন্ময়তা ভাঙে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি বানানো সিগারেট ধরাতে গিয়ে। সিগারেটটা টানতে টানতে শিমেল নতুন এক ঘোরের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে। সে ঘোর চেনাজানা কিন্তু অন্যরকম। সকলের মাঝে নিজেকে আলাদা মনে হয়, গর্হিত অপরাধী মনে হয়; সে হিমেশের দিকে তাকায়। হিমেশ দেয়াশলাইয়ের বাক্সটা নিয়ে আপন মনেই খেলে যাচ্ছে। নিজের সন্তানের মতোই হিমেশের প্রতি সম্মোহন অটুট থাকে শিমেলের। মনে হয় তার মতোই তার সন্তানটি আলাদা এক মানুষ। নিজেকে আরো বেশি অপরাধি মনে হয় তার। সন্তানের সামনে ওরকম গাঁজা খেয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকতে পারে কোনো মানুষ। আড্ডায় খানিকক্ষণের নিরবতা নামে শিমেলের চোখ যায় নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা বালিয়ারিতে। দুপুরের রোদে চকচক করা বালি আর প্রবাহিত স্বচ্ছ নদীর জলে তার মন পুরনো স্মৃতি-গহ্বরে প্রবেশ করে।
-শোভার কথা মনে আছে তোর? শিমেলের তন্ময়তা ভাঙে মুসোলিনির প্রশ্নে
-কোন শোভা?
-ঐ যে মনলোভা হাউসের।
হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে, মনে থাকবে না কেন? ঢালিউডের বাংলাছবির নায়িকার মতো যে খুব সতিপনার কাহিনী শোনাতে চেয়েছিল। তুই-ই তো শুনতে চাইলি না, তোর মনে আছে?
-হ্যাঁ, মনে আছে, মুসোলিনি জানায়।
হঠাৎ হিমেশের দিকে চোখ যায় শিমেলের। সংগে সংগে মোহিনীবিবরের ঘোর যেন কেটে যায়। ভেতরে প্রচণ্ড এক বিরক্তিভাব নিয়ে সে মুসোরিনির দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ সে জীবনেও দেখেনি। শিশু হোক তাতে কী, নিজের সন্তানের সামনে এরকম বাজে বিষয় নিয়ে কেউ আলোচনা করতে পারে। শিমেল স্তব্ধ, অবাক তাকিয়ে থাকে মুসোলিনির দিকে। মুসোলিনির কোনো বিরক্তি নেই। তার চোখ থেকে বেরিয়ে আসছে সেদিনের সেই অবাধ্যতা, প্রিয় মানুষের ডাক শুনতে না পাওয়ার অবিশ্বাস। যেন সেই অপরাধে মুসোলিনির কাছে শিমেল অপরাধী। শিমেলের মানসিক অবস্থার উল্টোগতি তৈরি হয়। তারপর কী ভেবে এই বিষয়টা পাশ কাটিয়ে মুসোলিনি বলে, অনেক সময় পার হয়ে গেছে এবার ওঠা যাক। সবাই আমার বাসায় চল কাকলির সংগে তোদের পরিচয় করিয়ে দেবো। আমরা সবাই দুপুরের খাবার একসাথে খাবো।
কাকলি? সবার প্রশ্ন।
মানে, রোকসানা কবির কাকলি। আমার বউ।
সন্ধ্যায় সংগ্রহশালার স্ট্রিটলাইটের আলোয় কাকলি ভাবিকে দেখে পুনরায় অবাক, বিষ্ময়ে স্তব্ধিত হয়ে যায় শিমেল। সে বিষ্মত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ভাবির দিকে। ভাবি দেখতে অবিকল শোভার মতো। মুসোলিনি এটা কি করেছে? হয়ত এটাই স্বাভাবিক। লজ্জানত হয়ে আসে শিমেলের মাথা। যথারীতি তার বেদনার্ত চোখ যায় ভাবির বুকের ওপর তারপর হিমেশের দিকে।
প্রথম দেখাতেই তুই কী আমার বউয়ের প্রেমে পড়ে গেলি রে, শিমেলকে সিরিয়াসলি স্যাটায়ার করে মুসোলিনি।
-না, ব্যাপারটা এরকম না, লজ্জানত শিমেলের জবাব।
দুপুরে সবাই মুসোলিনির বাসায় গেলেও শিমেলের যাওয়া হয়নি। কাজ থাকায় সে চলে এসেছিল। কাঞ্চন, মুসোলিনির পরের বন্ধু। সে ভেবেছিলো পরে কাঞ্চনসহ ভাবির সাথে পরিচিত হয়ে আসবে কিন্তু সারাবিকেল তন্নতন্ন করেও কাঞ্চনের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না আর মোবাইলটাও রেখেছে বন্ধ করে। অগত্যা সে একাই আড্ডায় উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণ পর বেদনার্ত সাগরও এসে উপস্থিত হয়। খুবই বিষণ্ন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায় সুহাস আর আমাদের মাঝে নাই রে।
সকলেরই প্রশ্ন, কী হয়েছে সুহাসের?
লেবানন বৈরুতে এক যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। আজই ওর লাশ রাস্ট্রিয় মর্যাদায় দেশে নিয়ে আসা হয়। এবং সমাধির জন্য গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়।
কাঞ্চন ওখানেই ছিল, ফিরে এসে ফোনে জানিয়েছে। লেবানন, সিরিয়া যুদ্ধ চলছে কয়েক বছর। বাংলাদেশ সরকার লেবাননের পক্ষে কয়েক হাজার সেনাসদস্য সেখানে পাঠিয়েছিল। আমাদের বন্ধু সুহাস বিশ্বাস ছিল তাদেরই একজন।

শোকার্ত শিমেল বাসায় ফিরে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবে। তার মনে পড়ে বেশ কয়েক বছর আগে এক বন্ধু দিবসে কোনো বন্ধুর দেখা না পেয়ে সে মন খারাপ হয়ে একা একা শুয়েছিল হঠাৎ হটপটভর্তি কাইলা মাছের ভর্তা, আতপ চালের ভাত আর মুরগির ঝালফ্রাই নিয়ে সুহাস উপস্থিত হয়। দুজন একসাথে খেয়ে আনন্দেই কাটিয়েছিল দিনটি। সেই সুহাসকে আর দিব্যজগতে দেখা যাবে না। বেদনার্ত শিমেল তার ডায়রিটা হাতে নেয়, বন্ধুবিয়োগে, তার স্মৃতিতে কিছু লিখবে কিন্তু পারে না। তার ভাবনা স্তব্ধ হয়ে আসে। ডায়রির পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে পাতার ভাঁজে রাখা কিছুটা মিকচার পেয়ে যায় শিমেল। কখনো সিগারেট বানানোর সময় উদ্ধৃত্ত রয়ে গিয়েছিল হয়ত। সে একটা সিগারেট রিফিল করে টান দেয় আর তার চিরচেনা মোহিনীবিবরে প্রবেশ করে। কিছুই ভালো লাগে না তার। সবকিছু অনর্থক নিরর্থক মনে হয়।
কাঞ্চন ফোন করে, বলে, খুব খারাপ লাগতাছে দোস্ত, সুহাসের জন্য খুবই খারাপ লাগতাছে। কিছুক্ষণ কান্নাভাব নিরব থাকে। তারপর বলে বাংলাদেশ সরকার লেবানন-যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মৃতিতে একটি বিশেষ স্থাপনা নির্মাণ করবে ঢাকার মিটফোর্ডে। স্থাপনাটির নাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘মনুমেন্ট নিউট্রেন্ড’ বলে কল রেখে দেয়।
শিমেল যথারীতি ভাবতে থাকে ঐশ্বরিয়ার কথা, ছোট ভাইয়ের কথা, আকতার ভাইয়ের কথা, মুসোলিনির কথা, শোভার কথা, হিমেশের কথা, কাকলি ভাবির কথা, সুহাসের কথা।
হিমেশকে মনে হয় তার। বড়ই শান্ত। স্থিতধির হয়েছে ছেলেটা। ভবিষ্যতে অন্তত আমাদের মতো মাল্টিপার্সোনালিটি ডিজর্ডার ম্যান হওয়ার সম্ভাবনা নেই তার। সে ভাবতে থাকে একটি সুন্দর স্থাপনা। প্রতিবেশ। মনুমেন্ট নিউট্রেন্ড। আর ভেসে ওঠে মনুমেন্ট ফলকে লেখা কবি ফরিদ কবিরের ‘মন্ত্র-২২’ কবিতার পঙক্তিগুলো।