Friday, July 3, 2009

বিরল কাহনের কল্পগল্প ও তার খসড়া

প্রণম্য পাঠক, একটু সচেতন হলে বোঝা যাবে যে ইনি নিতান্তই একটি শাদামাটা গল্প তৈরির কল্পনায় ফাঁদ পাতার চেষ্টা প্রায়শই করে থাকেন। তার এ প্রবণতার কারণ তিনি একজন সফল গল্পকার হয়ে ওঠেন না নিজের কাছেই। জনান্তিকে তিনি এ কথাও বলে বেড়ান যে, একটি ভালো গল্প লেখার কল্পনাচেষ্টায় বেশ কিছুদিন রত আছেন তিনি। তার সম্পর্কে আরেকটু স্পষ্ট ধারণা দিতে, প্রণম্য পাঠক অগ্রেই বলে রাখি, তিনি একজন সফল গল্পকার না হলেও সম্প্রতি তার একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পাণিনির অষ্ঠাধ্যায়ী। সুধিমহলে এরকম শোনা যায় যে কাব্যটির শিল্পমাণ নেহায়েত মন্দ নয়। গল্পকার বিরল কাহন অবশ্য এর ভিন্ন মন্তব্য করে থাকেন ‘একটি ভালো গল্প তৈরির প্লট মাথায় নিয়ে কল্পনা করেও যখন শেষমেশ গল্পটি লেখা হয়ে ওঠেনি, তখন ভীষণ মনোকষ্ট নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি সপ্তাহের পর সপ্তাহ। দিনলিপি লেখার মৃদৃ অভ্যাস আমার ছিল। ওই ব্যর্থতার সময়েই আবেগভরে নিয়মিত দিনলিপি লিখা হতো।
আমার গল্পের প্রাথমিক থিম শ্রোতার মধ্যে যারা আছেন তারা অর্থাৎ আমার বন্ধু, অফিসের কলিগ ও প্রাক্তন ম্যাসের কয়েকজন প্রাইভেট টিউটর প্রায়ই বলে থাকেন যে, আমার গল্পের থিমের চেয়ে দিনলিপিগুলোর বিশ্লেষণ তাদের কাছে অনেক সুখপাঠ্য কাব্য। শেষমেশ যেহেতু আমার কোনো গল্প লেখা আজো হয়ে ওঠেনি তাই অগত্যা দিনলিপিগুলোই কাব্য বলে এক প্রকাশক বরাবর জমা দিয়েছিলাম। এগুলো যথার্থ কাব্য বলে মনে হলেও সে বিষয়ে আমার বিশেষ কোনো কৌতূহল বা অতিব্যঞ্জনা নেই। আমার একান্ত লক্ষ হচ্ছে গল্পলেখা। আমার বান্ধবী নজিতা, সে অবশ্য আমার গল্পলেখার ব্যাপারে খুবই হতাশ। দীর্ঘদিন লিখবো লিখবো করেও লেখা হচ্ছিলো না বলে। আমার এক কলিগের বন্ধুপত্নী সে। বন্ধুসূত্রে তার বাসায় হঠাৎ হঠাত সান্ধ্যআড্ডায় উপস্থিত হতাম আমরা। স্বামীর চেয়ে একটু বেশি চঞ্চল স্বভাবের, সেটা অবশ্যই অতি কথনের পর্যায়ে পড়ে না। ওর প্রতি আমার স্বাভাবিক দুর্বলতা কিংবা সহানুভূতির কারণ হচ্ছে, মৃদু উষ্ণ একটি শহরের শিক্ষিতা মেয়ে সে। অধিকাংশ সময়েই বিষাদাক্রান্ত। একটি কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষিকা। দুবছরের একটি মেয়ে আছে তার। নাম চর্যা। তার এই বিষাদাক্রান্ততা বা আত্মমগ্নতার কোনো সুস্পষ্ট কারণ আবিস্কৃত হয়নি এখনো। অবশ্য সে ব্যাপারে উদ্বিগ্নও নই আমি বরং উদ্বিগ্ন আমার গল্পলেখা বিষয়ে তার হতাশার কথা জেনে। আদৌ কী আমার কোনোদিন একটি গল্প লেখা হয়ে ওঠবে? বৃথাই কী চেষ্টাআত্তি করে যাচ্ছি আমি।’
সহৃদয় পাঠক, গল্পকার বিরল কাহন শেষমেশ কোনো গল্প লিখবেন কী লিখবেন না সে বিষয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই কিন্তু স্বাভাবিক কৌতূহল হচ্ছে যেসব গল্প লিখবেন বলে তিনি কল্পআখ্যান তৈরি করেন। সেগুলো থেকেও একটি চমতকার গল্পের পাণ্ডুলিপি দাঁড় করাতে পারেন তিনি। কিন্তু এখনো তার লিখতে না পারার কারণ একটি প্রশ্নবোধকের মধ্যে দোদুল্যমান। সম্প্রতি তিনি বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রির নাম সূচিতা, একজন ওয়েব প্রোগ্রামার। অবশ্য তাকে পুরোপুরি প্রোগ্রামার বলাও ঠিক হবে না কারণ সদ্য তিনি ইটার্নি শেষ করেছেন। বর্তমানে আইটি ফিল্ডের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। কোথাও কাজ করছেন না। স্বামী সম্পর্কে ভীষণ কৌতূহলী তিনিও। ‘আমার স্বামী কাজী লুতফর রহমান বিরল। ফিলোসফিতে অনার্স-মাস্টার্স। উচ্চতা ৫ ফুট ৯। ফর্সা। সুদর্শন। একেবারে প্রথম চোখে পড়ার মতো। তার সাথে পরিচয় আমার বড়বোন নজিতার বাসায়। প্রথম থেকেই ওর ব্যক্তিত্ব মনে লাগার মতো। নজিতাই দুজনকে বিয়ের অফার করেছিলো। আমাদের কারোরই অমতের কারণ ছিল না। নজিতার খুব ভালো বন্ধুসূত্রে তার সম্পর্কে আমারও ভালো ধারণা ছিল। শেষমেশ বিয়েটা হয়ে গেল। আপনাদের গল্পকার বিরল কাহন বিষয়ে আমার খুব বেশি কৌতূহল ছিল না কিন্তু বিয়ের পর থেকে তার এই সত্তাটি বিষয়ে প্রবল আকর্ষণ অনুভব করি। তার গল্পের প্রবল কল্পাখ্যান শুনে হঠাত আবিষ্কার করি তিনি কল্পনা থেকে খুব মজার মজার গল্প শোনাতেন বটে কিন্তু লিখতে পারছেন না। নিছক গল্পের একজন ভালো সমঝদার বা পাঠক ছিলাম না বলেই তার না লেখার কারণ আমারও অনাবিষ্কৃত।’
মানুষের উপলব্ধিশক্তি খুব বেশি প্রবল নয় বলে হয়তবা একেঅপরের অন্তর্গত সত্তাটিকে কোনদিন চেনা-জানা হয়ে ওঠে না। মহাবিপদ! ইনি গল্প না লিখলেও সৌরসাহিত্যে কম হবে বলে ধারণা পোষণ করি না। কিন্তু ইনি যদি গল্প নাই লিখবেন তবে নিজেকে গল্পকার বলে বেড়াবেন কেন? আমাদের কৌতূহল আরো বেড়ে ওঠতে থাকে। ফলে এখন তিনি আমাদের নিরীক্ষাসীমার মধ্যে অবস্থান করছেন। খুব তথ্য-তালাশ করে তার একজন বন্ধু পাওয়া গেল ইউনিভার্সিটিতে থাকা সময়ের। নাম সরোজ আহসান। কিন্তু আমাদের খুব বেশি তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন না। ‘কিডনী রোগে আক্রান্ত হলে আমার একবার ভারতে যেতে হয় চিকিতসার জন্যে। ভার্সিটি জীবনের প্রথম। নতুন এসেছি। জানাশোনা কম। প্রচুর টাকা প্রয়োজন। চারদিকে তাকালে বাঙালির কী করুণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি। প্রতিটি মানুষ আপন আপন কাজে ব্যস্ত! একা! ডানে-বামে কারো তাকাবার সুযোগ হয় না। কেউ কারো নয়! মনে হচ্ছিলো বিশাল অংকের টাকা পরিবারের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। সুতরাং চিকিতসাও সম্ভব নয়, মৃত্যুই আমার চূড়ান্ত নিয়তি। করুণ হতাশায় মনটা ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছিলো। হঠাত এই ঘোর অমানিশায় বিরলের সংগে পরিচয়। ভদ্রোচিত চেহারা। ফর্সা। লম্বা। মাথায় সামান্য টাক। প্রকৃতির প্রতি ভরসার আশ্বাস দেন। বিরলই শেষমেশ দিনের পর দিন আমাকে নিয়ে সকল ছাত্রাবাস, বিভিন্ন মহল ঘুরে ঘুরে চিকিৎসার লাখ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ভারতে নিয়ে যায়। মূলত বিরলের চেষ্টার জন্যেই আমার আজো বেঁচে থাকতে পারা। এরপর থেকে ভার্সিটিতে বিরলই আমার একমাত্র কাছের বন্ধু। বিচিত্র জাতের গাছের শুকনো পাতা সংগ্রহ করা তার একধরনের অভ্যাস। সে যেসব জায়গায় বিচরণ করেছে সেখান থেকেই কোনো না কোনো শুকনো পাতা সংগ্রহ করে এনেছে। এরকম কাজের কী ব্যাখ্যা আছে আমার জানা নেই। হঠাত কাউকে না বলে রুম থেকে একমাস/দুমাস নিরুদ্দেশ, কোথাও চলে যাওয়া। আবার মাস-দুয়েক পর কাপড়-চোপড়, চুল-দাড়ি, নখ, রুগ্ন ও নোংরা হয়ে পুনরায় ফিরে আসা। এরকম বহুবার করেছে। জিজ্ঞেশ করলে উত্তর দিতো ‘ভালো লাগছিলো না কিছুই তাই হেঁটে হেঁটে উত্তরবঙ্গ ঘুরে এলাম। প্রতিবারই কোন না কোন নতুন জায়গা। একটি বিষয় বলে রাখি বিভিন্নস্থানের পুরনো রাজবাড়ি, স্থাপনা, পতিতালয়, দ্বীপাঞ্চল, বনাঞ্চল দর্শন ইত্যাদি ছিল তার প্রধান কৌতূহলের বিষয়। তার নোটবুক পড়লে পাওয়া যেত বিভিন্ন গাছের কথা, পাতার কথা, রাজবাড়ি-স্থাপনার বিবরণ, রাজা-রাণী, খোজা, রাজার উপপত্নী, গণিকা এদের বিচিত্র তথ্য ও সংস্কৃতির পরিচয়। দিনলিপি সংগ্রহ তার অনিয়মিত অভ্যাস। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে খাতার একেক পৃষ্ঠার মধ্যে পেন্সিল দিয়ে ছবি এঁকে রাখাই ছিল তার কাছে দিনলিপি। কল্পনা থেকে গল্প তৈরি ও বলা তার একটি অভ্যাস। মজার মজার কল্পগল্প শোনে চাঁদনীতে কেটে যেত রাতের পর রাত। আমার জীবন নিয়ে বিশেষ করে অসুস্থতা নিয়ে খুব সুন্দর একটি কল্পগল্প সে তৈরি করবে বলেছিল। আজঅব্দি তৈরি হলো কিনা জানা হলো না।’
গল্পকার বিরল কাহন জনপ্রিয় কোনো সুলেখক না হলেও ইতোমধ্যে তিনি আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তার বিচিত্র প্রকাশে। পাঠককুল, আপনারাও হয়ত নিজের মতো করে তাকে আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এদিকে তার না লেখার কারণ বিষয়ে আমাদের আবেগ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। ফলে একদিন কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিই তার না লেখার কারণ আমরা আবিষ্কার করবোই। রাত দশটা কী এগারোটা আমরা রওনা হই তার বাসার দিকে। আমাদের বিশ্বাস এসময় তাকে বাসায় পাওয়া যাবে। এবং পাওয়াও গেল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দরজা খুলে আমাদের দেখে তিনি কী বুঝেন কে জানে। হয়তবা আমরা তার নতুন কল্পগল্প শুনতে বাসায় এসেছি এই ভেবে অন্য কোনদিন আসার কথা বলেন। আমরা কেউ অমত করি না তবে আসার সময় তাকে তার বাসায় আসার মূল উদ্দেশ্যের কথা বলি এবং এও বলি যে আমাদের আবেগ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আমাদের কথা শোনার পর তিনি খানিক ভাবেন এবং বলেন ‘ঠিক আছে একথা আপনাদের জানাবো কিন্তু আজ নয়। আসলে আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ। মাথা ধরেছে। শুয়ে আছে। কথা বললে ওর ঘুমে অসুবিধা হবে তাই আপনাদের বসতে বলছি না। ক্ষমা করবেন।’ আমারা ফিরে আসি আর অপেক্ষা করতে থাকি কবে তিনি আমাদের কৌতূহলের জবাব দেবেন। আমাদের কৌতূহলের দিন পেরিয়ে যায়। একদিন-দুইদিন-তিনদিন, একসপ্তাহ-দুইসপ্তাহ, একমাস-দুইমাস। এবার আমরা তার না ডাকার কারণ সম্পর্কেও উদ্বিগ্ন হই। পূর্বের মতো আবারো আমরা তার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হই কিন্তু এবার তাকে পাওয়া গেল না। বাসায় একেবারে তালা লাগানো। দাড়োয়ানকে ডেকে তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে জানা গেলো, তিনি এ বাসা ছেড়ে চলে গেছেন বেশ কিছুদিন পূর্বে। দাড়োয়ান তার পকেট থেকে একটা শাদা খাম বের করে দিয়ে বললো ‘গল্পকার সাব যাবার সময় এই খামটি দিয়ে বললেন যদি তাকে কেউ খুঁজতে আসে তবে যেন এই চিঠিটি দিই।’ আমরা দ্রুত তার আরো কাছের দিকে এগিয়ে আসি। ‘দিন, দিন আমাদেরই চিঠি।’ তারপর খাম খুলে ভেতরের চিরকুটটি বের করে আনি। তাতে লিখা:
২৩ মার্চ ২০১০ বাংলাদেশ, পৃথিবী, সৌরজগত
সুপ্রিয় কৌতূহলীগণ
আমার প্রণাম ও ভালোবাসা জানবেন। আপনাদের কৌতূহলে শেষমেশ সাড়া না দিয়ে পারলাম না। দেরিতে জবাব দেবার জন্য খুবই দুঃখিত আমি। আসলে নিজের সাথে পেরে উঠছিলাম না। তবু একবার মনে হলো আপনাদের কৌতূহলের জবাব দিয়ে যাই। প্রারম্ভেই বলে রাখি আমি কোনো তথাকথিত গল্পকার নই। আপন মনে কল্পনায় গল্প তৈরি ও বলাই আমার নেশা। দশ/এগারো বছর পূর্বে গ্রাম থেকে আসা এক যুবক আমি। মৌলভী পিতার সূত্রে ছয় ভাইবোন আমরা। সকলেই মেধাবী ছিলাম। প্রকৃতির করুণ সত্য ও আমার পুরনো অতীত হচ্ছে একে একে পাঁচটি ভাইবোনকে ক্যান্সার রোগে হারানো। প্রিয় ভাইবোনদের হারিয়ে একা হতে থাকলাম প্রকৃতিতে। ক্রমশ মানুষের করুণা, স্নেহ, ভালোবাসা-প্রার্থী হতে থাকলাম আমি। সেই একাকীত্ব থেকেই তৈরি হতে থাকলো আমার কল্পাখ্যান। গ্রামে আমার পিতামাতা সন্তান হারানোর প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে এখন বসবাস করছেন। আমি ছাড়া তাদের আপন কেউ নেই। নজিতা, সূচিতা, আপনারা এবং বন্ধু-বান্ধব সকলের তাগিদে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম যে, এখন থেকে নিয়মিত গল্প লিখবো। কিন্তু বাকি ছিল প্রকৃতির আরেকটি চূড়ান্ত সত্য জানার। তবে সত্য কিংবা অসত্য সে বিষয়ে আপনাদের কিছুই জানাচ্ছি না। কেননা এ বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে গেলে পিতামাতা ও নববিবাহিত সূচিতার আর কোনো সান্ত্বনা থাকবে না। সেজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে গ্রামেই থাকবো বাবা-মার সংগে। আর উপভোগ করবো জীবনের চূড়ান্ত গল্পটির এক একটি পঙতি লিখিত হবার প্রসববেদনা। আপনাদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও শুভকামনা।
বিরল কাহন

No comments:

Post a Comment