Friday, July 3, 2009

মোহিনীবিবর

চোখ সকলকে দেখে, নিজেকে দেখে না
দেখে না, কারণ তার চারপাশ অন্ধকারময়

স্বয়ং চোখের এই পরিণতি দেখো- চক্ষুষ্মাণ কিন্তু অন্ধ

মানুষ নিজেকে ঠিক ততটুকু জানে
বেদনায় শরীর ভিজিয়ে ভাবে, বৃষ্টিতে ভিজেছে
এইভাবে চল্লিশটি আকাশ পেরিয়ে
উঠে যায় অন্য কোনো আকাশের খোঁজে

নিজেকে যায় না দেখা, এইকথা সব চোখ জানে
মানুষ জানে না

অগোছালো জীবন এখন প্রাত্যহিক নিয়ম তার, অবশ্য এই অবস্থাটা বাহির থেকে বোঝার নয়। গুছিয়ে থাকতে তারাই চায়, যাদের জীবন অগোছালো। বিকেলবেলা ঘরে ঢুকে মনে হলো তার...। এই সময় হঠাৎ-ই বা কেন ঘরে ঢুকলো সে? এ দুপুরে রিজন, ইকবাল, তাজ, কাঞ্চন, সাগর, এরা এসেছিলো, সবাই মিলে নিমাই টেনেছে; মাথাটা পাহাড়ের মতো ঝিম মেরে আছে। এবার মনে পড়েছে নিমাই টানার পর সে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো- এখন ফিরেছে কিন্তু কেন তা মনে করতে পারছে না। পেটে হালকা ক্ষুধা অনুভব করছে, ভাবে, সকালে রান্না করেছিলো কী? ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে যায়... ভাত আছে আর তরকারির পাতিলে একটা ডিম ভুনা করা; কোনো কিছু ভাববার আগে পেটটাকে শান্ত করার জন্য এখনই খেয়ে ফেলার দরকার। প্লেটটা ধুতে গিয়ে ঘরের কোণে চোখ পড়ে শিমেলের। পড়ন্ত বিকেলের কান্তি নিয়ে পড়ে আছে একটা ফুলগাছ, তাতে সদ্যফোঁটা প্রাণহীন একটি ফুল ঘুমন্ত অবস্থায়। কিন্তু এই গাছ এখানে এলো কী করে? নিশ্চয়ই পাশের বাসার নাক উঁচু বাঁদর মেয়েটার কাজ। সারমিন সোমা। সদ্য অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে সে, তাই এতো ফুটফুটানি। দেখতে ঠিক ঐশ্বরিয়া রাইয়ের মতো কিন্তু নাকটা রাবিনা ট্যান্ডনের মতো উঁচু। ঐশ্বরিয়াকে তার খুবই পছন্দ, ওইতো তার লেটেস্ট মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটাও সে দেখেছে কয়েকবার। ‘গুরু’। কিছুদিন আগে রাতে সে প্রায়ই ঐশ্বরিয়াকে স্বপ্নে দেখতো... এই ঘটনা বন্ধুদের বলার পর তারা খুব হাসাহাসি করেছিল। শালা গাধার মাথাটাই গেছে নেশা করে। জীবন এরকম সত্যি হয় নাকি, ওসব ভাবতে নিজেরও লজ্জা হয়। নাক উঁচু মেয়েটার কথা মনে হয় তার। প্রথম যেদিন সে এই ভাড়া বাসায় এসেছিল সেদিন রাতেই ঘরে ঢোকার সময় চোখে পড়ে একটি আধপচা লাউ দরজায় ঝুলানো। এরকম প্রায়ই থাকতো। প্রথম কিছুদিন আঁচ করতে পারেনি- পড়ে বুঝতে পারে এটি ওই বাঁদর মেয়েটার কাজ। এখন আর ওরকম করে না, কি জানি এই একাকিত্ব জীবন দেখে তার মায়া জেগেছে কিনা! টেররদের জন্য কারও মনে ভালবাসা সঞ্চিত থাকে এই সত্য উপলব্ধি করার মতো কোনো একটি দিন তার সামনে এসে উপস্থিত হয়নি, ফলে তার কল্পনা, কল্পনাই রয়ে গেছে। টেরর সন্তানদের জন্য পিতামাতারও মনে কোনো দরদ থাকে কিনা তাও বোঝার মতো কোনো সুযোগ হয়নি তার হয়ত দরদ বেশিই থাকে খারাপ সন্তানদের জন্য। মা মারা গেছে চার / পাঁচ বছর হয়, বাবাও পরে বিয়ে করেছে তিন / চার বছর হয়ে যায়; বিমাতার কারণেই তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। এসব মনে হতে হতে চোখ দুটি জলসিক্ত হতে থাকে, কেমন আছে ছোটভাইটি... না জানি কত কষ্টে আছে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাবা বলে দিয়েছিলো যেন আর ফিরে না যায় বাড়িতে, যদি যায় তবে খুন করে ফেলবে। মা নেই তাই বাড়ি ফিরে কি লাভ? এই ছিল প্রথমের সান্ত্বনা কিন্তু ছোট ভাইটি মাঝে মাঝে এসে দেখে যায। এলেই সিনক্রিয়েট হয়, জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি... পিতামাতার অতি আদরের দুটি ভাই ছিল তারা। আজ তারাই কিনা মানুষের গঞ্জণায় বেড়ে ওঠছে পৃথিবীতে; একজন বিমাতার ঘরে আর সে প্রাণহীণ শহরের মানুষজনের অনাদরে।
জীবনের এই দুর্বিষহ যন্ত্রণার ভেতর থেকে তার কোমল মনটি এখন বেরিয়ে যেতে চায় কোনো এক অপরিচিত ভালবাসার কাছে... যেখানে চারপাশে শুধু ভালবাসা ঘিরে থাকে, থাকে নাকি? হয়ত থাকে, শিমেলের জানা নেই। গোধূলিবেলায় নদীর ধারে গিয়ে বসে আর মনে মনে প্রিয় কবির নাম কবিতার পঙক্তি আওড়ায় ‘নষ্টদের কোনো কষ্ট থাকে না।’ সত্যি কি তাই! নাক উঁচু মেয়েটির কথা মনে পড়ে... দূরে যে দাঁড়িয়ে থাকে... দেখে পলকের পর পলক... উপড়ে ফেলা ফুলগাছটি আবার যার নামে পুঁতে রেখেছে সে, মনে ভাবে যদি ভালবাসা থাকে তবে চারাটি বেঁচে ওঠবে। কিন্তু কার জন্য, টেররদের কেউ ভালবাসে নাকি! টেররদের মন আছে এ কথায় বিষ্মিত হয় আমাদের দেশের মানুষজন!
‘জীবনও আঁধারে পেয়েছি তোমারে চিরদিন পাশে থেকো বন্ধু’ কাঞ্চন গান ধরে গোধূলি সন্ধির নৃত্যে। ইকবাল বলে তুই বড় বেরসিক রে বাবা, এ সময় এমন গান কেউ গায়? এরকম সময়ে ‘দিবসও রজনি আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি’। তারপর শিমেলকে বলে, ধর না বাবা গানটা, সন্ধেটা জমে ওঠবে। আমাদের তো আর টিএসসি, চারুকলা, নাটক সরণি, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, জাতীয় সংসদ নেই আমরা বরং এখানে বসেই গোধূলি কল্যাণ সংঘের কথা ভাবি। শিমেল নিশ্চুপ থাকে। কাঞ্চন ইকবালকে বিরক্তির ঢঙে বলে তুই বড় পেঁচগি রে বাবা। টাডি সুপারি আর মাল্টিমশলায় তৈরি পান খেলে নাক-মুখ-কান যেরকম গরম হয়ে আসে সেরকম নেশাটা ধরেছিল মাত্র। শান্তিমতে গানটা গাইতে দিলি না। যাক, খাসা মোহিনীর তরতাজা একটা কলি থাকলে থুথু দিয়ে কসিয়ে একটা সিগারেট বানিয়ে ফুঁকতে পারলে পুনরায় গানে ডুব দেয়া যেত রিজন, তাজের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে কাঞ্চন।
আমাদের কাছে হেস্ নাই রে দোস্ত রিজন, তাজের জবাব। সাগর না এলে দ্বিতীয়বারের মতো মাইনক্যা আড্ডা দেয়া যাবে না বোধহয়। কাঞ্চন একটু অবাক হয়ে নড়েচড়ে বলে তাইতো সাগর শালা আজ এখনো আসেনি। এ এক জোতিষ পরাণ, অল্পসল্প দৈনিকী সংবাদ, পাড়ার খোঁজ-খবর আর ছোটখাটো ঝুট-ঝামেলা মেটাতে না পারলে যেন সে সাগরই নয়। বলতে বলতে সাগর এসে উপস্থিত। মোহিনীবিবরের প্রত্যাশায় সবাই সাগরের দিকে তাকায়।
পালাইছে, নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে কথাটি না বলে সাগর আড্ডায় সমবেত হয়।
সকলের বিষ্ময়সূচক প্রশ্ন, কে পালাইছে?
ঐশ্বরিয়া, সাগরের জবাব।
সবাই শিমেলের দিকে তাকিয়ে সাগরকে বলে, বালখিল্যতা করিস না, সত্যিই পালাইছে?
আমি কী তবে মিথ্যে বলছি নাকি? সাগর উত্তর দেয়। বিকেলবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে একটা মাল কিনতে গেছি। সেখানে রাফির সাথে দেখা, সেই প্রথম খবরটা দিয়েছে। পরে নানার দোকানে চা খেতে খেতে ফাঁকে নানার কাছে ডিটেল জানলাম। ঐ যে ঘুরঘুর করতো না ঢাকায়া ছেলেটা, তার সাথেই পালাইছে।
এবার কাঞ্চন ওঠে বসে, শিমেলের দিকে একবার তাকায়; বলে, যাক বাবা বাল দিয়ে চেন হয় হলো তাহলে। বাল হলে চেন হয়, চেন হলে বাল হয় এইতত্ত্বে আমার বিশ্বাস ছিল না, আজ হলো। পাখি তো ফুট্ রে এবার তোর কী হবে?
আমার কী হবে মানে? শিমেল বলে।
তোরা না, না বুঝে অযথাই এ ব্যাপারে আমাকে জর্জরিত করিস।
বারে! তুই না প্রেম করবি বলে ছিঁড়ে ফেলা ফুলগাছটা ওর নামে লাগিয়েছিলি?
ভালোবাসা থাকলে ফুলগাছটা বেঁচে ওঠবে, এই শর্তে লাগিয়েছিলাম, ওর সাথে প্রেম করবো বলে নয়, শিমেলের উত্তর।

আকতার ভাই আড্ডায় আসলে শিমেলের মনটা অন্যরকম ফুরফুরে মেজাজে থাকে। আকতার জামিল। পেশায় সাংবাদিক, হিমু স্বভাবেব আড্ডায় স্বতোঃস্ফূর্ত মজার মানুষ। গতকাল এসেছিলো। রাতভর চুটিয়ে কার্ড খেলে সকালে শিমেলকে নাস্তা করিয়ে কাজ আছে বলে চলে গেছে। যথারীতি নিত্যবিবরের মানসিকতা নিয়ে ঘরে ঢুকে শিমেল। উন্মুক্ত ঠিকাদারির কিছু কাগজপত্র ফাইলে গুছিয়ে নেয়। অফিসপাড়ায় কিছু ঠিকাদারি ধান্দা আছে। ছোটখাটো ছিঁচকে টেররগোছের পরিচয়ধারী ছেলেদের অফিসপাড়ায় বসদের সেক্রেটারির কাছে কদর একটু কমই থাকে আর সামাজিক অবস্থানটা তো খুবই বাজে হয়। শিমেল অবশ্য এর ব্যাতিক্রম, স্বাভাবিক ভদ্রতায় সে অফিসপাড়ায় তার উন্মুক্ত ঠিকাদারি কাজটা চালিয়ে নিতে পারে। তবু বিবিধ যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে ভাবে সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে বহুদূর অজানা কোথাও চলে যাবে। কিন্তু যাবে কোথায় আর গিয়েই বা কী করবে? তারচে এই ভালো ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না’।
সেলফোনে মুসোলিনির কল, বিষ্মিত শিমেলের প্রশ্ন, এতদিন পরে তুই, কিরে? কোত্থেকে? কেমন আছিস?
আমি আর সাগর জয়নুল সংগ্রহশালার সামনে বসে আছি, তুই দ্রুত পার্কে চলে আয়।
এখনি আসছি বলে, কল রাখে শিমেল।
সগির উদ্দিন। অসম্ভব ডানপিঠে, বদমেজাজি আর হিটলারি বুদ্ধির সিভিল সার্জন। শিমেলদের আড্ডায় সকলের চেয়ে দু-তিন বছরের বড় ছিল। ওর কার্যকলাপের জন্যই সবাই তাকে মুসোলিনি বলে ডাকতো। শিমেলের এই অগোছালো জীবন, তাস খেলা, মোহিনীবিবরের সূত্রমুখও তৈরি হয়েছিল এই সগির উদ্দিন মুসোলিনির মাধ্যমে।
শিমেল বাসা থেকে বেরিয়ে নানার দোকানে গিয়ে চা-সিগারেট খেতে খেতে নানা-কে মুসোলিনির খবরটা দেয়। নানা বৃদ্ধ বয়সেও যেন এসব উদ্ভট তরুণদের উৎকট যাপিত জীবনের বৈচিত্রতায় নিত্যই চাঙ্গা হয়ে ওঠেন।
রিক্সায় জয়নুল সংগ্রহশালার দিকে যেতে যেতে একটি ঘটনার কথা স্মরণ হলো শিমেলের। কলেজে থার্ড ইয়ারের বার্ষিক পরীক্ষা। রুবি মেডাম তখন অন্ত:সত্ত্বা। ডেলিভারির ডেটও খুব নিকটে চলে এসেছিল বোধহয়। ঐ অবস্থায়ই মেডামের ডিউটি পড়ে আমাদের হলে। বিষয়টি কী হয়েছিল বন্ধুদের কেউ বুঝতে পারেনি। পরীক্ষা চলাকালিন সময়ে ম্যাডাম রুম থেকে যান এবং জুলফিকার স্যারকে ডিউটিতে পাঠান। ইংরেজির শিক্ষক তার উপর খুব রাগি। স্যার হলে এসে মুসোলিনির পরীক্ষার খাতাটি নিয়ে নেন এবং ইংরেজিতে খুব কড়া গালিগালাজসহ তাকে হল থেকে বের করে দেন। পরে ঘটনাটি মুসোলিনির কাছ থেকেই জানা হলো। পরীক্ষার সময় সে নাকি তার আন্ডারওয়্যারবিহীন প্যান্টের জিপার খুলে লিঙ্গদেশ হা-করা মুখের মতো চুল বের করে বসে পরীক্ষা দিচ্ছিল এবং এক পা রেখেছিল বেঞ্চের বাইরে। ম্যাডাম যখন তার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ডিউটি করছিলেন তখন নাকি সে বলেছিল, ম্যাডাম একটু দেখেশুনে হাঁটাচড়া কইরেন, পড়ে গেলে তো আবার আপনার সমস্যা হবে। মুসোলিনির আর ডিগ্রি পরীক্ষা দেয়া হয়নি। সে বছরই সে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। একেবারে সুন্দরবন। দশ-পনের দিন পর ফিরে আসে। এসেই বন্ধুদের মাঝে উদ্ভট কথা ছড়ায়। সুন্দরবন গেলে প্রিয় মানুষের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। মুসোলিনির বাবা ছিল না, বড় ভাইদের সংসারে বেড়ে ওঠা ছেলে সে।
তুই সুন্দরবন যাবি? শিমেলকে জিজ্ঞেস করে মুসোলিনি। প্রিয় মানুষের ডাক শুনতে পাবি, একদম জীবন্ত ডাক। আচ্ছা তোর প্রিয় মানুষ কে রে, বাবা না মা?
প্রিয় মানুষের ডাক শুনতে পাওয়ার বিষয়টি শিমেল বুঝতে পারে না। সে মুসোলিনির দিকে অবাক ভঙ্গিতে তাকায়, বলে, আমি ওসব বিশ্বাস করি না।
তুই এইসব বুঝস্ রে মূর্খ, তুই এইসব বুঝস্ বলে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দেয়। ধর, নে, খা মোহিনী দিয়ে বানানো খুব মজা পাবি, আনন্দ পাবি, ফিলিংস হবে তোর।
এর কিছুদিন পর আবার বাড়ি থেকে উধাও। অনেকদিন কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি মুসোলিনি কোথায় আছে। বছরখানেক পর খবর পাওয়া গেল সে সিরাজগঞ্জ আছে, তাড়াশে, ওখানে বিয়ে করেছে।

দুপুরের হালকা গরমে গাছের ছায়ায় ইকবাল, রিজনসহ আড্ডারত মুসোলিনিকে ক্ষাণিক দূর থেকেই আবিষ্কার করলো শিমেল। সবমিলিয়ে মুসোলিনিকে একটু উজ্জ্বলই মনে হলো তার। দীর্ঘদিন পর বন্ধু-দর্শনের জন্য উদগ্রীব সে কাছাকাছি গিয়ে একটু অবাক হলো, সকলের মাঝে একজন শিশু আড্ডারুও আছে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে শিমেল বুঝতে পারে বাচ্চাটি মুসোলিনির। শিমেল মুসোলিনিকে জড়িয়ে ধরে এবং খুবই আবেগাপ্লুত হয়। দুজনের স্বাভাবিক কুশল বিনিময় শেষ হলে হালকা রৌদ্র-ছায়ায় আপন মনে খেলতে থাকা শিশুটির দিকে তাকিয়ে মুসোলিনিকে জিজ্ঞে করে শিমেল, তোর ছেলে?
হ্যাঁ, হিমেশ। হিমেশ রেশমিয়া, আমার ছেলে।
সম্মোহনের মতো হিমেশের দিকে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে থাকে শিমেল। হিমেশকে তার নিজের সন্তানের মতো মনে হয়। সে হিমেশের সামনে আদরের ভঙ্গিতে বসে কিন্তু তার স্বাভাবিক আদরের সঞ্চারণে আত্মমগ্ন-ক্রীড়ারত হিমেশের হৃদয় সঞ্চারিত হয় কিনা উপলব্ধি হয় না শিমেলের। সে মুসোলিনিকে জিজ্ঞেস করে ভাবি আসেনি?
-এসেছে।
-তাহলে এখানে নিয়ে আসিস্নি কেন?
-দুপুরের এই রোদে প্রশান্তির একটি আড্ডা হবে না তাই ওকে বাসায় রেখে এসেছি।
সকলেরই একপর্ব মোহিনীসম্ভাষণ হয়েছে, অনুমিত শিমেলের তন্ময়তা ভাঙে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি বানানো সিগারেট ধরাতে গিয়ে। সিগারেটটা টানতে টানতে শিমেল নতুন এক ঘোরের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে। সে ঘোর চেনাজানা কিন্তু অন্যরকম। সকলের মাঝে নিজেকে আলাদা মনে হয়, গর্হিত অপরাধী মনে হয়; সে হিমেশের দিকে তাকায়। হিমেশ দেয়াশলাইয়ের বাক্সটা নিয়ে আপন মনেই খেলে যাচ্ছে। নিজের সন্তানের মতোই হিমেশের প্রতি সম্মোহন অটুট থাকে শিমেলের। মনে হয় তার মতোই তার সন্তানটি আলাদা এক মানুষ। নিজেকে আরো বেশি অপরাধি মনে হয় তার। সন্তানের সামনে ওরকম গাঁজা খেয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকতে পারে কোনো মানুষ। আড্ডায় খানিকক্ষণের নিরবতা নামে শিমেলের চোখ যায় নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা বালিয়ারিতে। দুপুরের রোদে চকচক করা বালি আর প্রবাহিত স্বচ্ছ নদীর জলে তার মন পুরনো স্মৃতি-গহ্বরে প্রবেশ করে।
-শোভার কথা মনে আছে তোর? শিমেলের তন্ময়তা ভাঙে মুসোলিনির প্রশ্নে
-কোন শোভা?
-ঐ যে মনলোভা হাউসের।
হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে, মনে থাকবে না কেন? ঢালিউডের বাংলাছবির নায়িকার মতো যে খুব সতিপনার কাহিনী শোনাতে চেয়েছিল। তুই-ই তো শুনতে চাইলি না, তোর মনে আছে?
-হ্যাঁ, মনে আছে, মুসোলিনি জানায়।
হঠাৎ হিমেশের দিকে চোখ যায় শিমেলের। সংগে সংগে মোহিনীবিবরের ঘোর যেন কেটে যায়। ভেতরে প্রচণ্ড এক বিরক্তিভাব নিয়ে সে মুসোরিনির দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ সে জীবনেও দেখেনি। শিশু হোক তাতে কী, নিজের সন্তানের সামনে এরকম বাজে বিষয় নিয়ে কেউ আলোচনা করতে পারে। শিমেল স্তব্ধ, অবাক তাকিয়ে থাকে মুসোলিনির দিকে। মুসোলিনির কোনো বিরক্তি নেই। তার চোখ থেকে বেরিয়ে আসছে সেদিনের সেই অবাধ্যতা, প্রিয় মানুষের ডাক শুনতে না পাওয়ার অবিশ্বাস। যেন সেই অপরাধে মুসোলিনির কাছে শিমেল অপরাধী। শিমেলের মানসিক অবস্থার উল্টোগতি তৈরি হয়। তারপর কী ভেবে এই বিষয়টা পাশ কাটিয়ে মুসোলিনি বলে, অনেক সময় পার হয়ে গেছে এবার ওঠা যাক। সবাই আমার বাসায় চল কাকলির সংগে তোদের পরিচয় করিয়ে দেবো। আমরা সবাই দুপুরের খাবার একসাথে খাবো।
কাকলি? সবার প্রশ্ন।
মানে, রোকসানা কবির কাকলি। আমার বউ।
সন্ধ্যায় সংগ্রহশালার স্ট্রিটলাইটের আলোয় কাকলি ভাবিকে দেখে পুনরায় অবাক, বিষ্ময়ে স্তব্ধিত হয়ে যায় শিমেল। সে বিষ্মত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ভাবির দিকে। ভাবি দেখতে অবিকল শোভার মতো। মুসোলিনি এটা কি করেছে? হয়ত এটাই স্বাভাবিক। লজ্জানত হয়ে আসে শিমেলের মাথা। যথারীতি তার বেদনার্ত চোখ যায় ভাবির বুকের ওপর তারপর হিমেশের দিকে।
প্রথম দেখাতেই তুই কী আমার বউয়ের প্রেমে পড়ে গেলি রে, শিমেলকে সিরিয়াসলি স্যাটায়ার করে মুসোলিনি।
-না, ব্যাপারটা এরকম না, লজ্জানত শিমেলের জবাব।
দুপুরে সবাই মুসোলিনির বাসায় গেলেও শিমেলের যাওয়া হয়নি। কাজ থাকায় সে চলে এসেছিল। কাঞ্চন, মুসোলিনির পরের বন্ধু। সে ভেবেছিলো পরে কাঞ্চনসহ ভাবির সাথে পরিচিত হয়ে আসবে কিন্তু সারাবিকেল তন্নতন্ন করেও কাঞ্চনের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না আর মোবাইলটাও রেখেছে বন্ধ করে। অগত্যা সে একাই আড্ডায় উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণ পর বেদনার্ত সাগরও এসে উপস্থিত হয়। খুবই বিষণ্ন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায় সুহাস আর আমাদের মাঝে নাই রে।
সকলেরই প্রশ্ন, কী হয়েছে সুহাসের?
লেবানন বৈরুতে এক যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। আজই ওর লাশ রাস্ট্রিয় মর্যাদায় দেশে নিয়ে আসা হয়। এবং সমাধির জন্য গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়।
কাঞ্চন ওখানেই ছিল, ফিরে এসে ফোনে জানিয়েছে। লেবানন, সিরিয়া যুদ্ধ চলছে কয়েক বছর। বাংলাদেশ সরকার লেবাননের পক্ষে কয়েক হাজার সেনাসদস্য সেখানে পাঠিয়েছিল। আমাদের বন্ধু সুহাস বিশ্বাস ছিল তাদেরই একজন।

শোকার্ত শিমেল বাসায় ফিরে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবে। তার মনে পড়ে বেশ কয়েক বছর আগে এক বন্ধু দিবসে কোনো বন্ধুর দেখা না পেয়ে সে মন খারাপ হয়ে একা একা শুয়েছিল হঠাৎ হটপটভর্তি কাইলা মাছের ভর্তা, আতপ চালের ভাত আর মুরগির ঝালফ্রাই নিয়ে সুহাস উপস্থিত হয়। দুজন একসাথে খেয়ে আনন্দেই কাটিয়েছিল দিনটি। সেই সুহাসকে আর দিব্যজগতে দেখা যাবে না। বেদনার্ত শিমেল তার ডায়রিটা হাতে নেয়, বন্ধুবিয়োগে, তার স্মৃতিতে কিছু লিখবে কিন্তু পারে না। তার ভাবনা স্তব্ধ হয়ে আসে। ডায়রির পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে পাতার ভাঁজে রাখা কিছুটা মিকচার পেয়ে যায় শিমেল। কখনো সিগারেট বানানোর সময় উদ্ধৃত্ত রয়ে গিয়েছিল হয়ত। সে একটা সিগারেট রিফিল করে টান দেয় আর তার চিরচেনা মোহিনীবিবরে প্রবেশ করে। কিছুই ভালো লাগে না তার। সবকিছু অনর্থক নিরর্থক মনে হয়।
কাঞ্চন ফোন করে, বলে, খুব খারাপ লাগতাছে দোস্ত, সুহাসের জন্য খুবই খারাপ লাগতাছে। কিছুক্ষণ কান্নাভাব নিরব থাকে। তারপর বলে বাংলাদেশ সরকার লেবানন-যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মৃতিতে একটি বিশেষ স্থাপনা নির্মাণ করবে ঢাকার মিটফোর্ডে। স্থাপনাটির নাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘মনুমেন্ট নিউট্রেন্ড’ বলে কল রেখে দেয়।
শিমেল যথারীতি ভাবতে থাকে ঐশ্বরিয়ার কথা, ছোট ভাইয়ের কথা, আকতার ভাইয়ের কথা, মুসোলিনির কথা, শোভার কথা, হিমেশের কথা, কাকলি ভাবির কথা, সুহাসের কথা।
হিমেশকে মনে হয় তার। বড়ই শান্ত। স্থিতধির হয়েছে ছেলেটা। ভবিষ্যতে অন্তত আমাদের মতো মাল্টিপার্সোনালিটি ডিজর্ডার ম্যান হওয়ার সম্ভাবনা নেই তার। সে ভাবতে থাকে একটি সুন্দর স্থাপনা। প্রতিবেশ। মনুমেন্ট নিউট্রেন্ড। আর ভেসে ওঠে মনুমেন্ট ফলকে লেখা কবি ফরিদ কবিরের ‘মন্ত্র-২২’ কবিতার পঙক্তিগুলো।

No comments:

Post a Comment